বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নারীর প্রতি সহিংসতা ও ভিকটিম ব্লেমিং 

আপডেট : ০৬ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:১৫

প্রকৃতিতে জাঁকিয়ে বসছে শীত। ঘন কুয়াশার হিমশীতল সন্ধ্যায় হাঁটতে বেরুলেই দেখা যায় টিমটিমে চুলায় উনুন জ্বলছে জায়গায় জায়গায়। সেখানে মধ্যবয়সি নারী থেকে বৃদ্ধ নারী সবাই পিঠা বানাচ্ছে এক মনে। কখনো কখনো পাশে থাকছে তার পুরুষ সঙ্গীটিও। এটি নগরীর খুবই পরিচিত দৃশ্য বলে আলাদা করে চোখে পড়ছে না আমাদের। অথচ গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে দৃশ্যটির তাৎপর্য চোখে পড়বে সবার। তাৎপর্যটি হলো পুরুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ। 

সবাই বলে, নারীরা আর কোনোদিকেই পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই। নারীরা ডাক্তার হচ্ছেন, প্লেন চালাচ্ছেন, দেশ শাসন করছেন, ক্যামেরা হাতে ছুটে বেড়াছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। এসবই যেন হয়ে গেছে নারী উন্নয়নের প্রধান মানদণ্ড। অথচ এদেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নারীদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা কত অবহেলায়ই না আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। এদেশের পোশাকশিল্প টেনে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন নারীরাই।

বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের পরেও নারীর প্রতি অন্যায়-অবিচার-সহিংসতার পটভূমি অতীতের চেয়ে খুব বেশি বদলায়নি। উলটো নারীর ক্ষমতায়ন যত বাড়ছে, সেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে নারীধর্ষণ, যৌনহয়রানি, নির্যাতনের মতো ঘটনা। কিছু দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থী মারা গেলেন স্বামীর হাতে নির্মমভাবে অত্যাচারের শিকার হয়ে। এই মর্মান্তিক ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই কক্সবাজারের মতো পর্যটন এলাকায় ঘটল স্বামী সন্তানকে জিম্মি রেখে নারীকে গণধর্ষণ। ২০২১-এর মাঝামাঝিতেই সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে চাঞ্চল্যকর গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষণের প্রতিবাদে অনেকেই বলেছিলেন, কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের যেন সেই এলাকার ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে প্রশাসন বাধ্য হয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এই ভাবনাটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুবই হাস্যকর এবং কল্পনাপ্রসূত। কেননা এই বঙ্গদেশের মেয়েরা নিজের ঘর থেকে শুরু করে, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া কোথাওই নিরাপদ নয়। যদি বয়কটের সংস্কৃতি চালু করে এদেশে নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া সব সহিংসতা কমানো যায়, তবে পুরো বাংলাদেশকেই বয়কট করতে হয়। 

বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা, তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখানে দেশে বর্তমানে ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’ বিরাজ করছে। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, একমাত্র নারীর অর্থনৈতিক মুক্তিই পারে নারী অধিকারের পথ সুগম করতে। বেগম রোকেয়ার সমকালীন সমাজ বাস্তবতায়, অর্থনৈতিক মুক্তির চেয়ে সাহসী পদক্ষেপ ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা বিরাট অংশই যেখানে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণের অবদান, সেখানে বেগম রোকেয়ার কথামতো সমাজে নারী জাগরণের জোয়ার চলবার কথা। কেন সমাজে এত আধুনিকতার চল এলেও নারীর সামাজিক, সামগ্রিক অবস্থানে এখনো কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এলো না— তা সত্যিই ভাবনার উদ্রেক করে। এই পরিবর্তন না হওয়ার পেছনে পুরো দোষই কী পুরুষতান্ত্রিকতার ওপর বর্তায়? সেখানে কী স্বয়ং নারীদের কোনো ভূমিকা নেই?

পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদার তাঁর ‘সাতকাহন’ বইয়ে লিখেছিলেন, ‘মেয়েরাই মেয়েদের প্রধান শত্রু’। এই উক্তির সত্যতা যে কতখানি, তা আপনি সবচেয়ে ভালো বুঝবেন যদি কোনো লেডিস হোস্টেল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী হলগুলোতে থাকার সুযোগ হয়ে থাকে। নারী জাতির প্রতি একটি কথা প্রচলিত আছে যে, নারীরা প্রকৃতিতে পুরুষের চেয়ে বেশি ঈর্ষাপরায়ণ। নারীর প্রতি কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটলে পুরুষেরা যেমন সেই ভিকটিমের চরিত্রের দিকে আঙুল তুলতে থাকে, আঙুল তোলার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকে না নারীরাও। এখনো এদেশে অনেক শিক্ষিত সচেতন নারীই আছেন, যারা কিনা নারীর প্রতি হওয়া যে কোনো অন্যায়ে সেই ভিকটিম নারীকেই দোষী ভেবে থাকেন। তারা মনে করেন, যে কোনো অন্যায় মাত্রই হলো পুরুষের দেওয়া নারীর প্ররোচনার মোক্ষম জবাব। যেন নারীর উশকানি ছাড়া কোনো অপরাধই সংঘটিত হয় না। নিজেদের মধ্যে একতা, বিশ্বাস আর সহমর্মিতার প্রচণ্ড অভাব থাকার ফলে এখনো এদেশে নারীর সব ক্ষেত্রে অবদান থাকার পরেও নারী অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে, এখনো বেশির ভাগ সহিংসতাকারী অপরাধীই মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিচ্ছে বুক ফুলিয়ে। এই ব্যর্থতারই নির্মম পরিণতি হিসেবে পত্রিকার পাতায় ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, নিপীড়নের মতো মর্মান্তিক খবরগুলো দেখতে পাওয়া যায়। সেসব খবরে কিছুদিনের জন্য শিক্ষিত সমাজের টনক নড়ে উঠলেও সেই চেতনা মিলিয়ে যায় কদিন পরেই। নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া সব অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কবে আমরা সবাই একাত্ম হতে পারব, কবে ভিকটিম ব্লেমিং বাদ দিয়ে অপরাধের প্রতি কঠোর হতে পারব— সেটিই বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল ভাবনার বিষয়।

লেখক :শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/ ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন