প্রায়শই নারীদের যে গণপরিবহনে অনিরাপদ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, সে-কথা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমানে অনিরাপত্তার ক্ষেত্রটি অপ্রীতিকর স্পর্শ থেকে শুরু করে ধর্ষণে রূপ নিয়েছে এবং এর শিকার হচ্ছে আবালবৃদ্ধবনিতাসহ প্রায় সবাই। চলতি সময়ে বারংবার উঠে এসেছে গণপরিবহনে নারীদের যৌন হেনস্তার মতো ঘটনা। পুরুষ যাত্রী এমনকি পরিবহন-সংশ্লিষ্ট কর্মীরাও রীতিমতো মুখিয়ে থাকেন নারীদের শরীরে হাত দেওয়ার জন্য। যাত্রীবাহুল্যের কারণে পরিবহনগুলোতে একই সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় নারী ও পুরুষ যাত্রীদের। আর এমন ভিড়ের সুযোগেই হয়রানির শিকার হতে হয় নারী যাত্রীকে। রাতে নির্জন সময়ে বাস, লেগুনা, মাইক্রোবাস, ইজিবাইক, এমনকি নৌকায়ও সম্ভ্রমহানি করা হচ্ছে কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক নারীদেরকে।
বর্তমান সময়ে নারীরা বহির্মুখী। প্রতিদিনই তারা যাতায়াত করছেন স্কুল, কলেজ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে। এছাড়াও দেশের নারী গোষ্ঠীর একটা বড় অংশ যুক্ত আছে উত্পাদনমুখী গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গে। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে চাকরিজীবী নারীর সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি এবং ক্রমে এ সংখ্যায় যুক্ত হচ্ছে আরো নারী। নারী চাকরিজীবী হোক, গৃহিণী হোক কিংবা শিক্ষার্থী, প্রতিদিনই তাদের ব্যবহার করতে হচ্ছে গণপরিবহন এবং শিকার হতে হচ্ছে শারীরিক-মানসিক-মৌখিক লাঞ্ছনার।
সম্প্রতি ব্র্যাক কর্তৃক প্রকাশিত ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ নামক শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সি পুরুষদের দ্বারাই যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বেশির ভাগ নারী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিপীড়িত নারীরা বাড়তি সম্মানহানির ভয়ে মূক থাকেন অথবা ঘটনাস্থান থেকে সরে যান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে দু-একটি ঘটনা সামনে এলেও তা উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতোই।
নারীদের জন্য আলাদা পরিবহনব্যবস্থা না থাকায় হয়রানির বিষয়টি দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন কর্মস্থলে যথাসময়ে পৌঁছানোর জন্য রীতিমতো পুরুষের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাস বা ট্রেনে উঠতে হয় নারীদের। পরিবহনে তোলার ছলে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের অভিযোগ রয়েছে গাড়ির সহকারীদের বিরুদ্ধে। অনিরাপত্তার প্রশ্নে সর্বদাই তত্পর থেকে এসেছে একদল ছিনতাইকারী। চলতি বাস থেকে হরহামেশাই তারা ছিনিয়ে নিচ্ছে গহনা, টাকা, পার্স এবং মোবাইল ফোন। রাতে নির্জন সময়ে বাসকর্মীরাও চড়াও হচ্ছে নারীদের ওপর এবং ছিনিয়ে নিচ্ছে কাছে থাকা মূল্যবান বস্তু। গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাও এক্ষেত্রে বিরল নয়। গণপরিবহনে একাকী যাতায়াত নারীদের কাছে আজ অস্বস্তিকর ও অনিরাপদ এক ব্যবস্থা।
এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি আমজনতার মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। নৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের আয়োজন সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবহনে স্থাপন করতে হবে সিসি ক্যামেরার মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি। পরিবহন ব্যবস্থা বৃদ্ধির পাশাপাশি নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রয়োজনে গণপরিবহনগুলোতে এমন নীতি চালু করতে হবে, যেখানে বাসের আসনসংখ্যা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমানভাবে বণ্টিত হবে। গণপরিবহনে নারীর হয়রানির ঘটনা চেপে যাওয়ার পরিবর্তে শ্লীলতা হরণকারীদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। গণপরিবহন নারীর একাকী পথচলায় অন্তরায় নয়, বরং হোক এগিয়ে চলার সহায়ক—এই আমাদের কাম্য।
লেখক :শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়