যান্ত্রিক নগরী ঢাকার শিশু-কিশোরদের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র ছিল শাহবাগের শিশুপার্ক। সরকারিভাবে চালু হওয়া দেশের প্রথম শিশুপার্কটি প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। পার্কের উন্নয়ন কাজের জন্য টিনের বেড়া দিয়ে পুরো পার্কটি ঘিরে রাখা হয়েছে। অথচ তিন বছর পার হলেও এখনো শুরু হয়নি ডিএসসিসি অংশের উন্নয়ন কাজ। কিন্তু বন্ধ টিনের বেড়ার ভেতর পার্কের কিছু অংশ জুড়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ বিশাল ফুলের মার্কেট। এতদিনেও চালু না হওয়ায় প্রতিদিনই শিশু-কিশোররা এসে ফিরে যাচ্ছে। এতে ক্ষোভ জানিয়েছে, শিশুপার্কে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা।
পার্কের নিরাপত্তা প্রহরী শফিউদ্দিন জানান, প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসছে। তারা মনে করেছে, এতদিনে চালু হয়ে গেছে পার্ক। কিন্তু তাদের বুঝিয়ে ফেরত পাঠাতে হচ্ছে। ছুটির দিনে মানুষ বেশি আসে। মানুষকে আর কতদিন এভাবে বুঝিয়ে ফেরত দিব।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. তৌহিদুল হক বলেন, শহরের শিশুদের প্রতিদিনের নির্দিষ্ট সময় বিনোদনের জন্য রাখা উচিত। ঢাকা শহরে বিনোদনের সে সময় এবং সুযোগ না থাকায় শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শিশুদের আলাদা বিনোদনের ব্যবস্থা থাকা উচিত। আগে সে ব্যবস্থা কিছুটা থাকলেও তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। ফলে শিশুর নেতৃত্বগুণ, প্রাণোচ্ছ্বলতা ধরে রাখা ও সঠিক সামাজিকীকরণ সম্ভব হবে না। সে জন্য শিশুদের কথা বিবেচনা করে দ্রুত পার্কটি খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে পার্কের সামনে একটি বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে পার্কটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে বলা হয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (৩য় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় শিশুপার্কের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের কাজ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন থাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় শিশুপার্ক সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ থাকবে। স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয়ে ২০১৯ সালের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। একই সময়ের মধ্যে পার্কের আধুনিকায়নের কাজ করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এর পরেই শিশুপার্কটি খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্পের মূল বরাদ্দ ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা থেকে ৭৮ কোটি টাকা দক্ষিণ সিটিকে দেওয়া হয়।
পরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে ডিএসসিসি জানায়, শিশুপার্কের বিদ্যমান রাইডগুলো ঝুঁকিপূর্ণ, নতুন রাইড বসাতে হবে। রাইড বসানো এবং পার্কের উন্নয়নে এই বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। পরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে দক্ষিণ সিটিকে নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে শিশুপার্কের আধুনিকায়ন করতে বলা হয়। পরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রায় ৬৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে পার্কটি আধুনিকায়ন করে পরে চালু করা হবে বলে জানা গেছে। তবে পার্কটি কবে চালু হবে তা নিশ্চিত নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গণপূর্ত অধিদপ্তরের আওতায় এখনো ভূগর্ভস্থ গাড়ি পার্কিংয়ের কাজ চলছে। পরে জলাধারসহ হাঁটার পথ নির্মাণ করা হবে। আর গণপূর্তের কাজ শেষ হলেই সিটি করপোরেশন কাজ শুরু করবে। দীর্ঘদিন পার্কটি বন্ধ থাকলেও পার্কের শাহবাগ থানার পাশের অংশে গড়ে উঠেছে বিশাল ফুলের পাইকারি মার্কেট। টিন দিয়ে ঘেরাও করা অংশে প্রায় শতাধিক দোকান গড়ে তোলা হয়েছে। ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা জামানতে প্রতি মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা ভাড়া দেন দোকানিরা। ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড নামে ব্যানার টানিয়ে এ সব দোকান পরিচালনা করা হচ্ছে। সিটি করপোরেশন ও গণপূর্তের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে দোকান গড়ে তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
শাহবাগ বটতলা ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘১৯৮৫ সাল থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে আমরা একটি অংশে ফুলের ব্যবসা করে আসছি। তবে নতুন করে পার্কের জায়গা দখল করে যে মার্কেট গড়ে উঠেছে তা আমাদের নয়। তারা আলাদা একটি অংশ। এ বিষয়ে আমি কথা বলতে চাই না। তারা কীভাবে ম্যানেজ করে দোকান তুলেছে তারা জানেন।’
পার্কের বিষয়ে জানতে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে থাকা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক সার্কেল) আনিছুর রহমান বলেন, গণপূর্তের অংশের কাজ শেষ হলেই সিটি করপোরেশনের কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, গণপূর্তের কাজ শেষ না হলে তারা কাজ করতে পারবেন না। বেড়া দেওয়া পার্কের জায়গায় ফুল মার্কেটের বিষয়ে তিনি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান বলেন, শাহবাগে পার্কের জায়গা ও ফুটপাত দখল করে অবৈধ ফুল মার্কেটসহ দোকান উচ্ছেদের বিষয়ে ডিএসসিসিকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এখানো উচ্ছেদ হচ্ছে না। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি সরকারি জায়গা দখল করে রেখেছে।