অল্প কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ডিসি-৩ প্লেনের দুঃখজনক ক্র্যাশ করার ঘটনা সম্পর্কে লিখেছিলাম। লিখেছিলাম এই কথা মনে করে যে, আমার বয়স এখন ৮৩ বছর। এখন যদি আমি বাংলাদেশ বিমানের বিষয়ে কিছু না লিখি তবে ভবিষ্যতের এসব কথা আর কে লিখবে?
বাংলাদেশ বিমানে আসল দুর্নীতি শুরু হয় এরশাদ সাহেবের সময়। আমরা যে আজ বিশ্বে দুনীর্তিগ্রস্ত দেশের প্রথম কাতারে আছি, তার শুরুটা হয়েছিল ঐ সময়। সেই সময়েই মূলত দেশের অন্যান্য সংস্থার লোকদের মতো বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও দুনীর্তির সংক্রমণ ঘটে। বলা বাহুল্য, দেশের প্রেসিডেন্ট-মন্ত্রী-আমলারা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়লে ক্যানসার রোগের মতো দেশের সর্বত্রই এই রোগের ব্যাপ্তি ঘটে।
১৯৮২ সালের শেষের দিকের কথা। বাংলাদেশ বিমানের পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের তখনকার ডিজিএম মি. রইস উদ্দিন আমাকে বললেন, বিমান কতৃর্পক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের কাছ থেকে তিনখানা পুরোনো ডিসি-১০ এরোপ্লেন কিনবেন। এক-একখানা ডিসি-১০ এরোপ্লেনের মূল্য ঠিক করা হয়েছে ২৬ মিলিয়ন ডলার। এই প্রসঙ্গে পিআইএ, অর্থাত্ পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের ম্যানেজিং ডাইরেকটর মি. আলভার জামাল বিমানের এমডিকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স পিআইএয়ের কাছে ঐ ডিসি-১০ প্লেনগুলো এক-একখানার জন্য ১৭ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা এতে রাজি হননি। বরং ১৫ মিলিয়ন ডলারে আল ইতালিয়ার কাছ থেকে আরো উন্নতমানের ডিসি-১০ প্লেন কিনেছেন।
আনভার জামালের কথা একটু বলে নিই। তিনি পাকিস্তানি হলেও অতটা বাঙালি বিদ্বেষী ছিলেন না। তিনি ছিলেন, পার্শি ধর্মালম্বী। তিনি বিয়ে করেছিলেন একজন সুইডিশ নারীকে। তার দুটি মেয়ে সন্তান ছিল।
আমি পিআইতে পাইলট হিসেবে পাঁচ বছরের চেয়ে কিছু অধিককাল চাকরি করেছি। করাচিতে অবস্থান করার সময় আমরা কয়েক জন বাঙালি পাইলট অবস্থান করতাম করাচির মালির ক্যান্টনমেন্টের কাছে গ্রান্ড হোটেলে। ঐ হোটেলের সুইমিং পুলটি ছিল বিশাল এবং আকর্ষণীয়। ওখানে বিদেশিরা আসত প্রচুর সংখ্যায়। আলভার জামাল তার পরিবার নিয়ে প্রায়ই আসতেন। সাঁতারের দক্ষতার জন্য আমার কিছুটা সুনাম তৈরি হয়েছিল। ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম আলভার জামাল এবং তার পরিবারের সঙ্গে।
বাংলাদেশ বিমানের পাবলিক রিলেশন্স বিভাগে ডিজিএম রইসউদ্দিনের সঙ্গে আমার ভালো বন্ধুত্ব ছিল। আমি তাকে বললাম, পিআইএর এমডি আলভার জামালের চিঠির একখানা ফটোকপি আমাকে দিতে পারেন কিনা না। ঐ চিঠিখানার কোনো সদ্ব্যবহার করতে পারি কিনা দেখা যাক। তিনি চিঠিখানার ফটোকপি করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। তিনি তা আমাকে দিলেন এবং আমি তা তখনকার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা সংবাদে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করলাম।
সাংবাদিকরা যখন বিমানের এমডিকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলেন, তখন তিনি জানালেন ঐ এরোপ্লেনের মূল্য কমানোর চেষ্টা চলছে। অবশেষে বাংলাদেশ বিমান ডিসি-১০ প্লেনগুলো ২৩ মিলিয়ন ডলারে এক-একখানা কেনা হয়েছিল। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সকে বোধহয় প্রতিটি প্লেনের জন্য ১৫ মিলিয়ন করে মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছিল ঐ তিনখানা ডিসি-১০ প্লেন ক্রয় করতে গিয়ে, কে কতটা চুরি করেছিল, সে কথা বাদ দিয়ে স্মরণ করতে হবে, রইস উদ্দিন ভাইর নিমিত্তে বাংলাদেশ বিমানের ৯ বিলিয়ন ডলার ক্রয় খরচ বেচেছিল। আর একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ডিসি-১০ প্লেন প্রস্ত্ততকারী ম্যাকডোনাল্ড ডগলাস কোম্পানি সে সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, তারা আর ঐ এরোপ্লেন তৈরি করবে না। তখন যদ্দূর মনে পড়ে, আফ্রিকার একটি দেশ ম্যাকডোলাল্যান্ড কোম্পানিকে জানায়, তারা তাদের অর্ডার দেওয়া দুখানা ডিসি-১০ প্লেন আর নিতে চায় না। ঐ প্লেনের অর্ডার বা বুকিং দেওয়ার জন্য তারা যে অগ্রিম অর্থ প্রদান করেছিল, তাও তারা আর দাবি করবে না। অথচ ম্যাকডোনাল্ড ডগলাসের সর্বশেষ তৈরি করা ডিসি-১০ বিমানটি ৭৭ মিলিয়ন ডলারে ক্রয় করেছিল বাংলাদেশ বিমান। ঐ এরোপ্লেনটির আসল মূল্য ছিল আরো অনেক কম।
দুই.
ওই সময় দুজন বড় কর্মকর্তা ছিলেন খুব প্রভাবশালী। এক জন ছিলেন বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) পদমর্যাদার এবং অন্য জন ছিলেন সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) পদমর্যাদার। প্রথম জন ছিলেন এমডি এবং দ্বিতীয় জন ছিলেন ডিএমডি। এই ডিএমডি ছিলেন বেশি প্রভাবশালী। তাকে নাকি এরশাদ সাহেব ধর্মপুত্র বলে উল্লেখ করতেন। এমডি সাহেব তার চেয়ে পদমর্যাদায় ছোট হলেও ডিএমডি সাহেবকে ভয় করতেন।
বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ দেখলাম একদিন অল্পবয়সি একজন মেজর বিমানের জেনারেল ম্যানেজার হয়ে যোগদান করেছেন। ছয় মাস সময়ের মধ্যে তাকে ডিএমডি পদে প্রমোশন দেওয়া হলো এবং একই সময় তাকে বিমানের সব ক্রয়-বিক্রয় কমিটির প্রধানও করা হলো।
ক্রয়-বিক্রয় কমিটির প্রধান এবং বিমানের ডিএমডি হওয়ার সুবাধে বিমানের সব বোয়িং ৭০৭ প্লেনগুলোর পানির দামে বিক্রয় করার ব্যবস্থা করলেন নতুন এরোপ্লেন কেনার অজুহাতে ধর্মপুত্র। বিমানের এফ-২৭ এরোপ্লেনগুলোও তেমনি পানির দামে বিক্রয় করে দিয়েছিলেন। এই ডিএমডি ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে আর্থিকভাবে কতটা লাভবান হয়েছিলেন, তা আমার জানা নেই। দুখানা এটিপি বিমান কেনার পথ সুগম করতে বিমানের এফ-২৭ প্লেনগুলোও তাড়াহুড়ো করে বিক্রি করা হয়েছিল। এটিপি উড়োজাহাজ দুটি ক্রয়ের ব্যাপারে যে অনেক দুনীর্তি হয়েছিল তা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বিমানের আগের ও পরের দুনীর্তির মধ্যে এরোপ্লেন কেনা-বেচার দুনীর্তিই হলো বড় ফ্যাক্টর।
বাংলাদেশ বিমানের কথা বলতে গিয়ে আমার এক জন মনীষীর কথা খুব মনে পড়ে। ঐ মনীষী বলেছেন, তুমি যদি চিরদিন দরিদ্র হয়ে থাকতে চাও তবে সততার সঙ্গে জীবনযাপন করো।
আরেকটি ঘটনার কথা সংক্ষেপে বলছি:
বাংলাদেশ বিমান তার ডিসি-১০ প্লেনের একটি ইঞ্জিন হংকংয়ের একটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করেছিল। বিমানের ডিএমডি একই সময় ক্রয়-বিক্রয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন একথা তো আগেই উল্লেখ করেছি। ঐ ক্রয়-বিক্রয় কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন দুই জন প্রকৌশলী। ঐ প্রকৌশলীদ্বয় ওই কর্মকর্তাকে বললেন, ইঞ্জিনটা কিন্তু খুব কমদামে বিক্রি করে দিলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ডিএমডি প্রকৌশলীদ্বয়কে বাদ দিয়ে ক্রয় কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে বিক্রয় চুক্তিতে একাই স্বাক্ষর করলেন। হংকংয়ের যে কোম্পানি ইঞ্জিনটি ক্রয় করেছিল তারা চুক্তিতে একটি শর্ত যোগ করেছিল। শর্তটি দিল যে ইঞ্জিনটা হস্তান্তর করার আগে ৫০০ সাইকেল সম্পন্ন করে দিতে হবে।
ইঞ্জিনের পূর্বশক্তি ব্যবহার করে একবার টেকঅফ এবং ল্যান্ডিং করার পর এরোপ্লেনকে থামানোর জন্য রিভার্স শক্তি প্রয়োগে ইঞ্জিনের পূর্বশক্তি ব্যবহার করা অর্থাত্ একটি টেক এবং একটি ল্যান্ডিং দুটি মিলিয়ে হয় একটি সাইকেল। ৫০০ সাইকেল সম্পন্ন হওয়ার অর্থ ঐ ইঞ্জিনটা ৫০০ বার ল্যান্ডিং এবং টেকঅফ করতে পারবে। বিমানের যে ইঞ্জিনটা বিক্রি করা হয়েছিল ওটার তখন দশ-বারো সাইকেল বাকি ছিল। বিক্রয় করা ইঞ্জিনটাকে ওভারহল করে ৫০০ সাইকেল করে দিতে বিমানকে খরচ করতে হয়েছিল আড়াই লাখ ডলার। এই বাড়তি খরচের জন্য যথেষ্ট সমালোচনা হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একটি এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করতে হয়েছিল।
তদন্ত করতে যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিমানের এমডি তাকে বললেন, এ ব্যাপারে তিনি দোষী প্রমাণিত হবেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু আসলে তিনি দোষী নন। ইঞ্জিনের সাইকেল এই টেকনিক্যাল শব্দটি তিনি বুঝতে পারেননি। প্রকৌশল সদস্য দুই জনের পরামর্শেই তিনি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। এমডি সাহেব আসল দোষীকে বাদ দিয়ে ইঙ্গিত দিলেন নির্দোষ প্রকৌশলী দুই জনকে ফাঁসাও। সেই ডিএমডিকে এমডি সাহেব কেমন ভয় করতেন, আশা করি, পাঠক তা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আমি বিমানের দুনীর্তির মহাভারত লিখতে বসিনি। সামান্য কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলাম মাত্র।
তিন.
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন মন্ত্রী, তখনকার কথা বলছি। বিমানের বন্ধু স্থানীয় কর্মকর্তা আমাকে বললেন, এক দিন বাসায় আসেন। আপনাকে কিছু নথিপত্র দিব। আপনি জানতে পারবেন বর্তমানে বিমান কত সুন্দরভাবে চলছে, তা বুঝতে আর সমস্যা হবে না। এটা ১৯৯৪ বা ১৯৯৫ সাল হবে। ঐ বছর ১২ ফেব্র‚য়ারি বন্ধুবরের বাসায় গিয়ে ফ্লাইটসংক্রান্ত পরিসংখ্যানের কিছু নথিপত্র নিয়ে এলাম। ঐ নথিপত্র অনুযায়ী ২৯ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্র‚য়ারি পর্যন্ত কয় সপ্তাহের খতিয়ানে দেখা যায় বিমানের ৪১টি ডিসি-১০ ফ্লাইটের একটা ফ্লাইটও সঠিক সময় চলাচল করেনি। উক্ত সময়কালে এরিয়া বাস ৩১০-১০-১১৬টি ফ্লাইটের ১৭.২ শতাংশ ফ্লাইট নিযমিত সময় চলাচল করেছে। অভ্যন্তরিন ফ্লাইটগুলোর অবস্থাও ছিল তথৈবচ। পরের সপ্তাহ ১১ ফেব্র‚য়ারি পর্যন্ত সময়ে ৬৭ ডিসি ১০ প্লেনের মাত্র ১০টি ফ্লাইট চলেছে সময়মতো। এয়ার বাস প্লেন দিয়ে পরিচালিত ৯৬টি ফ্লাইটের মধ্যে মাত্র ১৬টি চলেছে নিয়মিত। আমি আর বেশি তথ্য পরিবেশন করে কাউকে বিব্রত করতে চাই না। মুক্তিযুদ্ধে শহিদ ক্যাপ্টেন আলমগীর ক্যাপ্টেন সেকেন্দার আলী ক্যাপ্টেন আমিরুল ইসলাম ক্যাপ্টেন এনএস হায়দারকে নিয়ে একদিন একটি লাভজনক এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেছিলাম।
বিমানের বর্তমান অবস্থানের কথা আমি তেমন কিছু জানি না। আমি ২১ বছর আগে বাংলাদেশ বিমান থেকে অবসর গ্রহণ করেছি। তবে এ বিষয়ে সাম্প্রতিক সময় ভাড়া কমানোর ব্যাপারে দু-তিনটি টেলিভিশন থেকে আমার মন্তব্য জানতে চেয়েছে। তাদের কাছে আমি কোনো মন্তব্য করিনি। তবে এ লেখায় একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করব।
১৯৭৪ সালে ক্যাপ্টেন রফি. জহির এবং আমিসহ বিমানের চারজন পাইলট ফিলিপাইন গিয়েছিলাম এফ ২৭ প্লেনের সিমুলেটর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে। তখন ম্যানিলা থেকে হংকং গিয়েছিলাম মার্কেটিং করতে। ওখানে গিয়ে দেখলাম বেশির ভাগ দোকানেই মূল্যহ্রাস চলছে। আসলে কোনো মূল্যহ্রাস ছিল না। তারা কেবল প্রতিটি জিনিসের আসল উল্লিখিত মূল্য ঠিক রেখে ওপরে দ্বিগুণ সংখ্যার একটি সংখ্যা লিখে দিয়ে সেটা ক্রস করে পাশে লিখে দেয় ৫০ শতাংশ মূল্যহ্রাস। বাংলাদেশ বিমানও একবারে অতিরিক্ত ভাড়ায় কিছুদিন টিকিট বিক্রি করে সেখান থেকে সামান্য দাম কমিয়েছে মাত্র। এটা হংকংয়ের দোকানগুলোর মতো একটি কৌশলমাত্র। আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু লিখতে চাই না। বিমানের বেশ কিছু সংখ্যক কর্মচারী এবং কর্মকর্তা যথেষ্ট কোণঠাসা হয়েও তাদের সততা বজায় রেখে চলেছেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা রইল।
লেখক: বীরপ্রতীক, বৈমানিক কিলো ফ্লাইট