বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সংলাপ, নির্বাচন ও গণতন্ত্র 

আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:৫১

রাজনীতিতে রাজনৈতিক আদর্শ ও সংগঠনের জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকার জায়গা থেকে মতানৈক্য থাকবে, এটি স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক পরিস্হিতি উত্তরণের জন্য আলাপ-আলোচনার বিকল্প নেই। রাজনীতিতে আলোচনার মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধানও হয়েছে এবং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া বলা যায়। এর মাধ্যমে দেশ ও জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিক সংকট দূর হয়। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে আলোচনা বা সংলাপের ডাক দিলেন, তা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক বলে মনে করি। তবে বিএনপি এই সংলাপ প্রক্রিয়ায় অংশ না নিয়ে তাদের দাবি উপস্থাপনের সুযোগ নষ্ট করেছে বলে মনে হয়।

মহামান্য রাষ্ট্রপতির আহ্বানে সাড়া দেয়নি দেশের অন্যতম একটি রাজনৈতিক দল বিএনপি। নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না বলে জানায় দলটির নীতিনির্ধারকরা। এমনকি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে আবেদন জানানোর সুযোগ ভাবাটাও অর্থহীন বলছেন তারা। নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন নিয়েও বিএনপি মাথা ঘামাচ্ছে না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা।

দেশে বিএনপির একটি ভোটব্যাংক আছে, জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা তাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার; কিন্তু রাষ্ট্রপতির সংলাপকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বরং তারা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। সংলাপে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের মতপ্রকাশের সুযোগ তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেন। এজন্য দল হিসেবে বিএনপির সমর্থকদের এককভাবে কাউকে দায়ী করার সুযোগ নেই। কেননা বিএনপি দলটি প্রকৃতপক্ষে কার নেতৃত্বে চলছে, এটি এক ধোঁয়াশায় রূপ নিয়েছে। সুতরাং দল হিসেবে রাজনৈতিক দেউলিয়া হওয়ার ফলে রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশগ্রহণ না করা স্বাভাবিক বলা যায়।

এবারের সংলাপে ইসি গঠনে একটি আইন করার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি দাবি উঠেছে। আওয়ামী লীগও মনে করে একটি আইন হতে পারে। কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদের পর যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হতে যাচ্ছে, তা নতুন আইনের অধীনেই হবে বলে প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এজন্য খসড়া আইনটি মন্ত্রিসভায় নীতিগতভাবে উত্থাপনের অনুমোদন পেয়েছে বলেও জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

তিনি বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮-এর বিধান সাপেক্ষে একটি উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। বর্তমানে এই ধরনের কোনো আইন না থাকায় সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারগণের নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধান ব্যতিরেকে অন্য কোনো আইন প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতা নেই।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে একটি রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে একমাত্র বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি সাংবিধানিক রীতি ও রাজনৈতিক অনুশীলন প্রতিষ্ঠা করেছে। এই সাংবিধানিক রীতিটি হলো ‘সার্চ কমিটি’ অথবা ‘অনুসন্ধান কমিটি’ গঠনের মাধ্যমে সবার মতামত ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন।’

এবার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আহ্বানে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হয় ৩২টি রাজনৈতিক দলকে। এবারের রাষ্ট্রপতি সংলাপে গণতন্ত্রী পার্টি সার্চ কমিটির পাশাপাশি একটি ‘বিশেষ কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে নিয়ে ঐ কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে। সার্চ কমিটি পাঁচটি নাম প্রস্তাব করবে কাউন্সিলের কাছে। কাউন্সিল নির্বাচন কমিশনারদের নাম সংক্ষেপ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন।

সরকারি দলের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি আইন প্রণয়নের সুপারিশের পাশাপাশি আপাতব্যবস্থা হিসেবে ইসি গঠনে সংসদকে কাজে লাগানোর প্রস্তাব দিয়েছে। দলটি চায় সার্চ কমিটি হোক সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিদের নিয়ে। রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নেওয়া প্রায় সব দলই সাংবিধানিক সংস্থা ইসি গঠনে সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়নের কথা জোরালোভাবে বলেছে।

সংলাপের শুরুর দিন জাতীয় পার্টি আইন প্রণয়নসহ তিন দফা দাবির সঙ্গে সার্চ কমিটির জন্য চার-পাঁচ জনের একটি তালিকা দিলেও নাম প্রকাশ করেনি তারা। অন্যদিকে বিকল্পধারা সার্চ কমিটির জন্য লেখক-অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যবসায়ী রোকেয়া আফজাল রহমান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞার নাম প্রস্তাব করে। সার্চ কমিটি গঠনের বিরোধিতাও এসেছে আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাছ থেকে।

নির্বাচন বর্জন, সংলাপ বর্জন, সংবিধানে স্বীকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্জনসহ নানা বর্জন-সংস্কৃতিতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখন ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী বিএনপি এবং তাদের সুহূৎ সংগঠনগুলো মিলে লক্ষ লক্ষ মার্কিন ডলার খরচ করেছে লবিস্ট নিয়োগের পেছনে—যাতে করে বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন ও সার্বিক অবস্থার অপপ্রচার চালিয়ে আন্তর্জাতিক প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে জনগণ বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব পেলেও বিএনপি থেকে কোনো প্রস্তাব বা মতামত পেল না। তাহলে জনগণের জন্য বিএনপির রাজনীতি কী? নির্বাচন বর্জনের পর থেকে বিএনপি যা কিছু বর্জন করে এসেছে, তা থেকে জনগণ কী পেয়েছে? বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বের মুখ থেকেই বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন সময়ে যে তাদের এই বর্জন রাজনীতি, তাদের ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং এই রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। দলটি যদি এখনো অতীত থেকে শিক্ষা না নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরো মূল্য দিতে হতে পারে। বিএনপি জনগণের জন্য রাজনীতি করলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাদের সমর্থকদের ভোটদানের সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত ছিল। দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন বর্জন করায় বিএনপির সমর্থকদের ভোটাধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। সুতরাং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কিংবা নির্বাচন প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য এখন গুরুত্ব বহন করে না। আশা করি, দেশের সাধারণ জনগণও বিষয়টি উপলব্ধি করবে। সর্বোপরি জনগণ এখন বর্জন রাজনীতি দেখতে চায় না, তারা উন্নয়নবান্ধব, ইতিবাচক ও স্বচ্ছ রাজনীতির পক্ষে।

লেখক: উপ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইটি) বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

ইত্তেফাক/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন