বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নারীর ক্ষমতায়নে চার কন্যার দেশ ভ্রমণ

আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০১৯, ১৯:৪৭

  মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

 

যেন তেন কারণে নারী লাঞ্ছিত, অপমানিত হয়। ন্যায্য অধিকারটুকু বুঝে পায় না। সাকিয়া এসব নিয়ে ভাবতেন। নারী হয়ে নারীর জন্য কিছু করতে চাইতেন। সাকিয়ার বন্ধু মানসী। বাল্যকালের বন্ধু। দুজনে টুকটাক ঘুরতেও যেতেন। দুজনের বাড়িই খুলনা। মানসীকে সাকিয়া তার ভাবনা শেয়ার করলেন। দুজনে দেশ ভ্রমণে একমত হলেন। এরই মধ্যে একদিন ক্লাসে ম্যাডাম বললেন, ম্যালেরিয়া কোথায় বেশি হয়? সাকিয়া বললো বান্দরবন। বান্দরবন কোন দিকে? সাকিয়া বললো, উত্তর দিকে। ওমনি হাসির রোল পড়ে গেলো। ম্যাডাম সাকিয়াকে ক্লাস থেকেই বের করে দিলেন। সেদিনই সাকিয়া প্রতিজ্ঞা করলেন। ৬৪টি জেলাই ভ্রমণ করবেন। ভ্রমণের ইচ্ছাটা তার মধ্যে পোক্ত হলো। পাশে পেলেন বন্ধু মানসীকে। শুরুতেই হোঁচট। বাসায় বলতেই ক্ষেপে গেলো সবাই। মেয়ে মানুষ, কোথায় যাবে, সাথে কে কে থাকবে এমন কত প্রশ্ন। দুজনই থাকলো তারা। দল ভারি হয়নি তখন। কোথাও যেতে পারলেন না। সাকিয়া, মানসীর তখন মন খুব খারাপ হলো। ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর। বুদ্ধি করে দুজনে গড়ে তুললেন ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ। তখনকার সময়ে একমাত্র নারী ট্রাভেলিং গ্রুপ। উদ্দেশ্য ছিলো নারীদের ভ্রমণে উত্সাহিত করা। পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করা। ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পরিবার তাদের ভ্রমণে বাধা হয়ে দাঁড়ালো না। তারা বুঝতে পারলো, মেয়েগুলো তো ভালো কাজই করছে। বললো সাকিয়া হক। ফেসবুকে ট্রাভেলেট’স অব বাংলাদেশের সদস্য সংখ্যা ২৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। নারীদের নিয়ে এই গ্রুপ মনপুরা, বগালেক, সেন্টমার্টিন, নাফাখুম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ইতিমধ্যে ভ্রমণ শেষ করেছে। ৪৭টি টুরের আয়োজন করেছে সংগঠনটি। রিফাত ফারজানা। গ্রুপের সাথে গোলাপ গ্রামে ভ্রমণে যান। পরে ফেসবুকে তিনি লিখেন, গ্রুপের সাথে আমার প্রথম ভ্রমণ ছিলো গোলাপ গ্রাম। আমি এদের ব্যবস্থাপনায় খুব খুশি। সামিমা বিথিকা লিখেন, এই গ্রুপের সাথে আমি আরো ভ্রমণে যেতে চাই।

ইতিমধ্যে সাকিয়া হক, মানসী সাহার ৬৪টি জেলা ভ্রমণ শেষ হয়েছে। ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ এর একটি প্রজেক্ট নারীর চোখে বাংলাদেশ। এই প্রজেক্টের আওতায় ৫৫টি জেলা ভ্রমণ শেষ হয়েছে। আটটি ধাপ সম্পন্ন করেছে তারা। বর্তমানে হবিগঞ্জে অবস্থান করছে ভ্রমণ কন্যারা।

স্কুল-কলেজে গিয়ে তারা নারীর ক্ষমতায়ন, বয়:সন্ধিকালীন সমস্যা সমাধান, খাদ্য, পুষ্টি সুরক্ষার কৌশল, স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশ্নোত্তর, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কথা বলেন। ভিডিও প্রদর্শন করেন। মেয়েরা নির্ভয়ে তাদের সমস্যার কথা খুলে বলে। সমাধানও পেয়ে যায়। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যান না কেন। ছাত্রীরা তাদের খুব আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে। উষ্ণ সংবর্ধনা জানায়। এটাই খুব আনন্দ দেয়। যাত্রা পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। বললো সাকিয়া হক। উল্টোটাও হয়েছে। নারী ঘর দোড় সামলাবে। সে কিনা  মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ায়। বেপর্দা, বেশরম। কেউ এমন উক্তিও করেছে। এগুলো সাকিয়া, সিলভী, মানসী, শামসুর নাহার সুমারা  মোটেও পাত্তা দেননি। দুর্গাপুর থেকে তাহেরপুর । খানাখন্দকে ভরা সড়ক। কিছুটা পথ মাটির রাস্তা। তার মধ্যে হয়েছে বৃষ্টি। গন্তব্যে পৌঁছতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এই দিনটাই ছিলো ভ্রমণ কন্যাদের খুব কষ্টের দিন। আবার বগুড়া থেকে নওগাঁ যাবার সময় স্কুটির চাকা পানচার হয়। হাইওয়ে সড়ক। মেরামতে বেশ বেগ পেতে হয়। বললো মানসী সাহা। প্রথম ৩৩ জেলা ভ্রমণের সব খরচ নিজেরাই বহন করে তারা। পরের জেলাগুলো ভ্রমণের তেল খরচ দেয় স্কয়ার গ্রুপ। প্রথমদিকে কর্নফুলী গ্রুপ দুটি স্কুটি কিনে দিয়েছিলো।

মেয়ে মানুষ যেখানে সেখানে তো আর থাকা যায় না। হোটেলে খরচাপাতি বেশ। ভ্রমণ কন্যাদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন নুরুন আখতার। তিনি বাংলাদেশ সরকারের ডেপুটি সেক্রেটারি। তিনি সব সার্কিট হাউজগুলোকে বলে দিলেন। ফলে কম খরচে রাতে থাকা, নাস্তার সুবিধা পেয়েছেন। এছাড়া নওগাঁর তসলিমা, হবিগঞ্জের এডিশনাল সেক্রেটারি জালাল আহমেদ, সাতক্ষীরার উতসর্গ, হিমু পরিবহন, প্রথম আলো বন্ধুসভা বিশেষভাবে সহযোগিতা করে বলে সাকিয়া জানান।

তবে নৌকা, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তির বাড়িতেও তারা থেকেছেন। মুজিব নগর কমপ্লেক্স যাবার ঘটনা ভ্রমণ কন্যারা আজও ভুলতে পারেন না। অন্ধকার রাত। শিয়ালের ডাক। সুনশান নিরবতা। কোথাও একটু আলো নেই। জনমানবহীন পথ। স্কুটির হেড লাইনের আলোটুকুই সম্বল। ভৌতিক পরিবেশ। ছুটে চলেছেন ভ্রমণ কন্যারা। ভয়ে তাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়েছিলো। এত ঘুটঘুটে অন্ধকার। জনমানবহীন পথ। তারা আগে চলেননি। মুজিব নগর কমপ্লেক্স এ গিয়েও দেখলেন অন্ধকার। পরে অবশ্য দারোয়ানকে খুঁজে পেলাম। আস্তে আস্তে ভয় কাটলো বললো সাকিয়া হক। সাধারণ মানুষ সব সময় ভ্রমণ কন্যাদের পাশে ছিলো। ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ জয়বাংলা কনটেস্ট ২০১৮-তে ফাইনালিস্ট ছিলো। নির্বাচিত ১০০ তরুণকে নিয়ে সেমিনার এর আয়োজন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে উপস্থিত থাকার সুযোগ পান সাকিয়া হক। ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের পক্ষে। ২০১৮-তেই ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় সম্মাননা পায় দেশের বাইরে থেকে। মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট মাহাথির মোহাম্মদ এর মেয়ে মেরিনা মাহাথির ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানায়। বিভিন্ন দেশের শতাধিক প্রতিনিধির মধ্যে ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের সাকিয়া হক নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বক্তব্য রাখেন।  সাকিয়া আর মানসী সাহা এই দুজন ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশে এর প্রতিষ্ঠাতা। তবে বিভিন্ন ইভেন্ট এর আয়োজনে কাজ করছেন নাজমুন নাহার মুক্তা, সাদিয়াতুল মুনতাহা জিদি, জান্নাতুল ফেরদৌস সুভা, রুমানা রশীদ তন্দ্রা, মুনতাহা রুম্মান, মেহজাবিন ফেরদৌস প্রভা, ইরিন জামান, নুসরাত জাহান রিজভী, কাজী শান্তা, মুক্তি সুলতানা, আসমা আকতার, টুম্মা প্রমাণিক, নিজুম রাফা, ফাওজিয়া নওসিন প্রমুখ। নারীর চোখে বাংলাদেশ প্রজেক্টে সবকটি জেলা সুস্থভাবে ভ্রমণ শেষ করাই আপতত ভ্রমণ কন্যাদের স্বপ্ন।

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন