শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

করোনাকালে নারী ও শিশু মাদকাসক্ত বেড়ে দ্বিগুণ

আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮:০০

আধুনিকতা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা, পিতামাতার তালাক বা পৃথক থাকা, মাদকাসক্ত বন্ধু, মাদক ব্যবসায়ীদের অপতত্পরতা, অনলাইনে সহজে মাদকদ্রব্য কেনার সুযোগসহ আরও কিছু কারণে দেশে দিন দিন বাড়ছে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা।

সরকারি ও বেসরকারি সেবাকেন্দ্রের তথ্য পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গত তিন বছরে নারী ও শিশু মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, সঠিক অভিভাবকের অভাব, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অসচেতনতা, পর্যাপ্ত মাদকাসক্ত নিরাময় ও চিকিৎসাসেবার অভাব বাড়িয়ে দিচ্ছে ঝুঁকি। তাছাড়া সামাজিক ট্যাবু বন্ধ করছে নারী মাদকাসক্তদের চিকিৎসা গ্রহণের পথ। শহরে উচ্চবিত্ত বা শিক্ষিত পরিবারের নারী মাদকাসক্তদের নিরাময়ের সুযোগ থাকলেও দরিদ্র ও অশিক্ষিত পরিবার নারী মাদকাসক্তদের তথ্য প্রকাশ করছে না। এতে অধিকাংশ মাদকাসক্ত নারী চিকিৎসার বাইরে রয়ে যাচ্ছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, সরকারি ও বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার ভিত্তিতে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২১ সালে নারী ও শিশু মাদকাসক্ত বেড়েছে দ্বিগুণ। ২০১৯ সালে চিকিৎসা নিয়েছে ৫৪৪ জন নারী ও শিশু রোগী। ২০২০ সালে নিয়েছে ১ হাজার ২৪২ জন এবং ২০২১ সালে চিকিৎসা নিয়েছে ১ হাজার ৭৬ জন।

প্রসঙ্গত, দেশে সরকারের চারটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র আছে। এর মধ্যে কেবলমাত্র ঢাকায় তেজগাঁও কেন্দ্রে নারীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এখানে নারীর জন্য ২০টি শয্যা আছে। অন্যদিকে বেসরকারি চিকিৎসা ও নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা ৩৬৬টি। এর মধ্যে ঢাকা আহছানিয়া মিশনে নারীদের জন্য সর্বাধিক ৩৬ শয্যার ব্যবস্থা আছে।

কেন বাড়ছে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা

নারী রোগীদের চিকিৎসার অভিজ্ঞতার আলোকে ঢাকা আহছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ডা. ইকবাল মাসুদ ইত্তেফাককে বলেন, সারা বিশ্বেই নারীর মাদক গ্রহণের প্রবণতা করোনা মহামারিতে বেড়েছে। বাংলাদেশে গত পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে ইয়াবা আসার পর থেকে এক শ্রেণির নারীর মাদকাসক্ত হওয়ার হার বেড়েছে। ইয়াবা নারীকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় এবং এনারজেটিক করে এমন ধারণা প্রচলিত। আমাদের নারী রোগীদের মধ্যে করা গবেষণায় দেখা যায়—এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতি  সহজে মাদক পাওয়া যায়, স্পটে যেতে হয় না তাই নারীরা আকৃষ্ট হচ্ছে। পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে অনেক তরুণী মাদকাসক্ত হয়, পরিবারের সদস্য কিংবা বাবা-মার মাদক গ্রহণেও নারীরা আকৃষ্ট হয়, বর্তমানে অভিজাত এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে বিনা মূল্যে মাদক সরবরাহ করে। তারা আসক্ত হলে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয় এবং তাদের মাদক বিক্রির কাজে ব্যবহার করে। এদের অনেকে গর্ভধারণ করে বাবা-মার সঙ্গে চিকিৎসার জন্য আসে। কিন্তু তারা কেউ জানে না তারা গর্ভবতী। তাছাড়া ডিজে ক্লাবগুলো নারীদের মাদকাসক্ত করছে। এখন সব শ্রেণির নারীই মাদকে আসক্ত হচ্ছে। উচ্চবিত্ত নারীরা নিরাময় কেন্দ্রে বেশি আসে। আর মধ্য ও নিম্নবিত্ত নারীরা সামাজিক ট্যাবুর কারণে বিষয়টি প্রকাশ করে কম। ৫০ জন শহুরে নারী আসলে পাঁচ জন প্রান্তিক নারী পাচ্ছি। পুরুষদের জন্য চিকিৎসার অনেক জায়গা তৈরি হয়েছে, কিন্তু চিকিৎসায় পিছিয়ে আছে নারী মাদকাসক্তরা।

প্রতিরোধে যা জরুরি

ডা. ইকবাল মাসুদ বলেন, মাদক প্রতিরোধে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে হবে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য এক রকম, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক রকম, ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আরেক রকম, আবার কমিউনিটির মানুষের জন্য অন্য রকম পরিকল্পনা করতে হবে। মাদক নির্মূলে জনপ্রতিনিধিদের কাজ করতে হবে। পারিবারিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে বাবা-মাকে ভালো অভিভাবক হতে হবে। সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। স্থানীয় সরকারকে এ বিষয়ে ক্ষমতায়িত করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

অধিদপ্তর কী বলে

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের পরিচালক মো. ফজলুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, কয়েক বছর ধরে পুরুষের পাশাপাশি নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। আমরা লক্ষ্য করছি বাড়ার পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক সংকট অন্যতম। অধিদপ্তর নারীদের জন্য চিকিৎসা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সারা দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা ও মাদকবিরোধী গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নসহ বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এতে মাদকাসক্তের সংখ্যা কমে আসবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।

ইত্তেফাক/ আরাফাত