এই ডিজিটাল জমানায় বিশ্ব জুড়েই তরুণদের মাধ্যে বই পড়ার প্রবণতা কমছে। তারা এখন সোশ্যাল মিডিয়াতেই বেশি সময় পার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘দি কিডস অ্যান্ড ফ্যামিলি রিডিং রিপোর্ট’ বলছে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সি ২৪ শতাংশ কিশোর-কিশোরী সপ্তাহে পাঁচ থেকে সাত দিন বই পড়ে। এই শতকরা হার আরো নিচে নেমে ১৭ শতাংশে এসে থেমেছে যখন টিনএজারদের মধ্যে জরিপ চালানো হয়েছে। ১৫ থেকে ১৭ বছরের কিশোরদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, এদের মধ্যে দিনের ৭৬ শতাংশ সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটায়।
এবার দেখা যাক, এখনো যারা শিশু এবং যারা কয়েক বছরের মধ্যেই টিনএজার হবে—তাদের কী অবস্থা। ছয় থেকে আট বছরের শিশুদের মধ্যে ৪৮ শতাংশই সেল ফোনে অ্যাপসের মাধ্যমে গেম খেলে। আর ৩৪ শতাংশ ইউটিউবে ভিডিও দেখে কাটায়। তাহলে, বছর জুড়ে যে এত বই বের হচ্ছে এসব বই পড়ে কারা। জরিপ বলছে, মূলত সিনিয়র সিটিজেনরাই বেশি বই পড়েন।
যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের বিচরণ কম তাই তাদের কাছেই রয়েছে বইয়ের কদর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘আমেরিকান টাইম ইউজ সার্ভে’ এবং ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ল্যাঙ্কাশায়ারের দুটি জরিপের এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এই যখন অবস্থা তখন পঞ্চগড়ের কলেজ পড়ুয়া আল আমিন মানুষকে বই পড়ানোর অভিনব পন্থা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। অবসরে কিংবা কাজের ফাঁকে যেটুকু সময় পাওয়া যায় তখনই বই পড়ার বিষয়ে মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে গড়ে তুলছেন সেলুন পাঠাগার। চুল কাটানো বা শেভ করানোর জন্য সেলুনে এলে এখান থেকে বই পড়তে পারবেন গ্রাহকরা। ভিড় বেশি হলে গ্রাহকরা বিরক্ত হয়ে ফিরে যান কিংবা সেলুনেই বসে অপেক্ষা করেন। তবে তাদের আর বিরক্ত হতে হবে না। যতক্ষণ নিজের সিরিয়াল না আসবে ততক্ষণ সুন্দর সুন্দর বই পড়েই সময় কাটাতে পারবেন। ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পঞ্চগড় জেলা শহরের ২১টি সেলুনে সেলুন পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তরুণ উদ্যোক্তা মকবুলার রহমান সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আল আমিন সেলুনগুলোতে পাঠাগার স্থাপন করবেন। জ্ঞানভিত্তিক জাতি গঠনে উন্নত সমাজ বিনির্মাণ ও বইয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করাই এই সেলুন পাঠাগার স্থাপনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলে জানান তিনি।
‘পড়িলে বই আলোকিত হই, না পড়িলে বই অন্ধকারে রই’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে গত মাসের শেষ সপ্তহে জেলা শহরের নিউ পারসন এক্সক্লুসিভ জেন্টস পার্লার সেলুনে প্রথম পাঠাগার উদ্বোধন করা হয়। কলেজের অধ্যক্ষ মো. দেলওয়ার হোসেন আনুষ্ঠানিকভাবে এই পাঠাগারের উদ্বোধন করেন। এ সময় অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক হাসনুর রশিদ বাবু, ব্যাংক এশিয়া পঞ্চগড় শাখার ম্যানেজার আব্দুল হামিদসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। সেলুনে পাঠাগার স্থাপনের পর শহরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিদিনই ভিড় করছেন।
জানা গেছে, পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নের পূর্বশিকারপুর গ্রামে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি পাঠাগার। এই পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আল আমিন এই সেলুন পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। জ্ঞানভিত্তিক জাতি গঠনে উন্নত সমাজ বিনির্মাণ ও বইয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা এই সেলুন পাঠাগার স্থাপনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জানান আল আমিন।
তরুণ উদ্যোক্তা আল আমিন জানান, চলতি ফেব্র‚য়ারি মাসের মধ্যে জেলা শহরের ২১টি সেলুন পাঠাগার গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছি। ইতিমধ্যে একটিতে স্থাপন করা হয়েছে। অনেক সেলুন মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। পাঠাগারে দেওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বই সংগ্রহ করা হচ্ছে। বেশির ভাগ তরুণ শিক্ষার্থী সেলুনে এসে অপেক্ষার সময়টুকু অনেকে স্মার্ট ফোনে গেম খেলে কাটিয়ে দেন। অনেকে বিরক্ত হন। গ্রাহকরা সেলুনে এসে যেন বিরক্ত না হন এবং সিরিয়াল পেতে অপেক্ষার সময়টা যেন বই পড়ে কাটাতে পারেন এজন্যই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঐ সময়ে সম্পূর্ণ বই পড়তে না পারলেও বইগুলো নাড়াচাড়া করতে পারবেন বইয়ের নাম ও লেখকের নামগুলো অন্তত জানতে পারবেন। ভালো লাগলে পরে তারা বইটি সংগ্রহ করতে পারবেন। তিনি আরো বলেন, আমি আমার ব্যক্তিগত টাকা থেকে বুক সেলফ বানানোর মজুরি দিয়েছি। কাউকে মিনি বুক সেলফ বানিয়ে দিয়েছি। আবার কোনো কোনো সেলুন মালিক নিজেই সবকিছু করবেন আমি শুধু বই দেব। তবে যারা আগ্রহী হবেন তাদেরই শুধু সেলুন পাঠাগার নির্মাণ করে দেওয়া হবে।
সেলুন পাঠাগারে কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, শরত্চন্দ চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বেগম রোকেয়া, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু, শিশুতোষ, ইতিহাস ঐতিহ্য পর্যটনের ওপর লেখা দেশীয় ও স্থানীয় লেখকদের ৪০টি করে বই সরবরাহ করা হবে। সরকারি বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে সহযোগিতা পেলে পুরো জেলায় এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন এই শিক্ষার্থী উদ্যোক্তা।
নিউ পারসন এক্সক্লুসিভ জেন্টস পার্লার সেলুনের পরিচালক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, আমার সেলুনে একটি মিনি পাঠাগার স্থাপন করতে চান। এ বিষয়ে আল আমিন ভাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমি সেলুনের ভেতরে বুক সেলফ বানিয়ে নিয়েছি। উনি মজুরির টাকা দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে তার এই উদ্যোগটি একটি ভালো উদ্যোগ।
সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমি নিয়মিত এই সেলুনের একজন গ্রাহক। এবার চুল কাটাতে এসে দেখলাম সেলুনে পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে। এটি দেখে আমি অভিভূত। এখন থেকে আর মোবাইল ম্যানিয়ায় অযথা সময় নষ্ট না করে বই পড়ে সময়টা কাটাতে পারব। অনেকগুলো বই দেখলাম আমার খুব ভালো লাগল।
অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক হাসনুর রশিদ বাবু জানান, বই মানুষকে আনন্দ দেয়, মানুষকে উত্সাহিত করে। সেই অর্থে এটা একটা নতুন ধারণা। চুল কাটাতে এসে মানুষের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হবে। সেলুন পাঠাগার স্থাপনে যে তরুণরা এই উদ্যোগ নিয়েছে তাদের প্রতি সাধুবাদ জানাই।
পঞ্চগড় মকবুলার রহমান সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. দেলওয়ার হোসেন বলেন, আজকের এই যুগে কমবেশি সকলেই ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমরা যদি ‘ফেস’ বাদ দিয়ে ‘বুক’ এর দিকে একটু ধাবিত হই তাহলে মানুষের পাঠ্যাভ্যাস গড়ে উঠবে। আল আমিনের এই উদ্যোগে এখানকার মানুষের মধ্যে বই পড়ার আনন্দ জেগে উঠুক, তার চিন্তার সফলতার মধ্য দিয়ে প্রকৃত মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন কিছু মানুষ তৈরি হোক এই প্রত্যাশা করি।