শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চিকিৎসাসেবায় অবহেলা কাম্য নয়

আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৭:২২

চিকিত্সাক্ষেত্রে অবহেলা বলতে সাধারণত চিকিত্সকের অবহেলাকে বোঝানো হলেও মুখ্যত এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নার্স, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, টেকনিশিয়ান, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ওষুধ সরবারহ এবং সার্বিক অব্যবস্থাপনাও জড়িত। করোনাকালীন মহাসংকটে প্রতিনিয়ত চিকিত্সায় অবহেলায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ উঠছে। চিকিত্সকদের পক্ষ থেকে জনবল সংকট ও নানা অজুহাত দেখানো হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, চিকিত্সায় অবহেলার দায়ে কাউকে অভিযুক্ত করতে চাইলে প্রথমত প্রমাণ করতে হবে যে, রোগী এবং চিকিত্সা সেবা প্রদানকারীর মধ্যে এমন একটি চুক্তি হয়েছিল, যার মাধ্যমে রোগীর প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেওয়া ও যত্ন নেওয়ার একটি আইনি দায়িত্ব চিকিত্সক বা চিকিত্সাসেবা প্রদানকারীর ছিল। দ্বিতীয়ত, যদি সেই দায়িত্ব পালনে চিকিত্সক বা চিকিত্সাসেবা প্রদানকারী অবহেলা করে বা ব্যর্থ হয় এবং তৃতীয়ত, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে উক্ত রোগী যদি ক্ষতির শিকার হন বা মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী চিকিত্সা সেবা রাষ্ট্রের নাগরিকের অন্যতম মৌলিক চাহিদা হলেও বর্তমানে এই খাতে চরম অরাজকতা দেখা যাচ্ছে। মেডিক্যাল প্রাকটিস ও প্রাইভেট ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিনেন্স ১৯৮২ নামে একটি আইন বিদ্যমান রয়েছে। এতে ডাক্তারদের প্রাইভেট প্রাক্টিসের ক্ষেত্রে ও প্রাইভেট ক্লিনিক স্হাপন ও পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়গুলো এ আইনের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। এ আইন অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত আছেন এমন কোনো রেজিস্ট্রার চিকিত্সক অফিস চলাকালীন সময়ে কোনো অবস্থায় কোনো বেসরকারি হাসপাতাল, প্রাইভেট ক্লিনিক বা নার্সিং হোমে প্রাইভেট প্রাক্টিস করতে পারবেন না এবং করলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্হা গ্রহণ করা যাবে। কিন্তু প্রায়শই শোনা যায়, সরকারি হাসপাতালে না গিয়ে সরকারি ডাক্তার প্রাইভেট হাসপাতালে সেবা দিতে বেশি ব্যস্ত থাকেন। ডিউটির সময় হাসপাতালে তাদেরকে পাওয়া যায় না কিংবা মফস্বলে পোস্টিং দিলে তারা অনুপস্হিত থাকেন। এর মূল কারণ হলো অপ্রতুল আইনি ব্যবস্হা, চিকিত্সাকে সেবা হিসেবে না দেখে ব্যবসায় হিসেবে দেখার, কোনো ধরনের জবাবদিহিতার ব্যবস্হা না থাকা ইত্যাদি।

প্রতি বছর সরকারের স্বাস্হ্য খাতে মোটা অঙ্কের বাজেট পাশ হয়। ডাক্তারদের স্বার্থরক্ষা হচ্ছে, কিন্তু চিকিত্সা সেবার উন্নতি হচ্ছে কতটুকু? এর মূল কারণ কোথাও জবাবদিহিতা নেই। কাউকে কোথাও বদলি করলে রাজনৈতিক তদবির তো আছে বৈকি। স্বাধীনতাপরবর্তী চিকিত্সায় কারিগরি মান অনেক উন্নত হলেও ডাক্তারি সেবায় পিছিয়ে রয়েছি আমরা। এর ফলে দেশের বিশাল অঙ্কের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। চিকিত্সাসংক্রান্ত অবহেলা একই সঙ্গে দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় ধরনের অপরাধের মধ্যে পড়ে। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলায় ডাক্তারি অবহেলার মধ্যে হয়রানি, মানহানি, মিথ্যা প্রলোভনসহ ক্ষতিপূরণের মামলা করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা ভিন্ন, একেবারেই প্রয়োজনীয় মনে না করলে নিম্ন মধ্যবিত্ত বা স্বল্পআয়ের লোকেরা ছাড়া কেউ সরকারি হাসপাতালে যান না। সরকারি হাসপাতালের রোগীরা সবচেয়ে ভোগান্তির শিকার হয়। অধিকাংশ সময় সরকারি হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়, গুরুত্ব দেওয়া হয় না এবং অনেক সময় দেখা যায় সিট না পেয়ে হাসপাতালের বারান্দাতে প্রাণ হারান রোগী।

আবার, প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে চলে অন্য রকমের দুর্নীতি। এখানে ডাক্তারের অতিরিক্ত ভিজিট ফি রাখা হয়, প্রয়োজনের অতিরিক্ত নানা ধরনের টেস্ট করতে বলা হয়, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় এবং অসুস্হ মানুষকে জিম্মি করে চলে নানা ধরনের ব্যবসা। সবশেষে, চিকিত্সায় অবহেলা প্রতিরোধ এবং রোগী ও চিকিত্সক উভয়ের আইনি সুরক্ষা দ্রুত নিশ্চিতকল্পে স্বাস্হ্য সুরক্ষা আইনের দ্রুত বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। দেশে চিকিত্সা সেবার নামে যে অরাজকতা চলছে তা চলতে পারে না।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন