২০২২ -এ একুশের বইমেলা নিয়ে অনেক শঙ্কা ছিল। করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপ বেড়ে যাওয়াতে সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য বইমেলা বাদ দেওয়ার কথা চিন্তা করা হচ্ছিল। আবার মাসব্যাপী না করে ১৫ দিন চালানোর চিন্তাও করা হলো। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখক প্রকাশক পাঠকের নানা মতামত তর্কবিতর্ক টিভি টক-শো বহু কিছু চলল। ফেব্রুয়ারিও চলে এলো। শেষমেশ ‘আপাতত ১৫ দিন, পরে পরিস্থিতি বুঝে বাড়ানো যাবে’ এভাবে ১৫ ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা শুরু হলো। উদ্বোধনী দিনে ভাচুর্য়ালি উপস্থিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী ১৭ মার্চ পর্যন্ত বইমেলা চালানোর একটি সবুজ সংকেতও দিয়ে দিলেন। এরপর সিদ্ধান্ত এলো ১৭ মার্চ পর্যন্তই হচ্ছে বইমেলা। করোনা পর্যুদস্ত জনগণ যেন এর অপেক্ষাতেই ছিল। এখন বইমেলায় ঢুকলে কে বলবে দেশের মানুষের কাছে করোনার ভয় বলে কোনো বস্ত্ত আছে! স্বাস্হ্যবিধি মানতে হবে তাই মুখে একটা মাস্ক। সেটাকেও বেশির ভাগই প্রবেশদ্বারের ছাড়পত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। বাঁশের ব্যারিকেড পার হলেই তা খুলে থুতনিতে নামিয়ে দেন অথবা কোনো পকেটে গুঁজে দেন।
করোনা সংক্রমণের কথা চিন্তা করে এ বছর বইমেলা আরো বিস্তৃত হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্হানান্তরিত হওয়ার পর থেকে প্রতি বছরই বইমেলার পরিসর বাড়ছে। মেলায় ঘোরাঘুরি করা, নির্বিঘ্নে স্টলে যেয়ে বই বাছাই করে পছন্দের বইটি কেনা এসব সুবিধার কথা ভেবে বাংলা একাডেমি মেলাকে প্রতি বছরই আগের চেয়ে ভালো ও সুবিধাজনক করে করার চেষ্টা করছে।
যখন বইমেলা ছিল একুশে গ্রম্হমেলা, বাংলা একাডেমির ছোট প্রাঙ্গণে, পুকুরের ধার ঘেঁষে অপরিসর জায়গাটুকুর মধ্যে গা ঘেঁসাঘেঁসি করে নির্মাণ করা হত স্টল, এক গেট দিয়ে লোকজন ঢুকতো আর এক গেট দিয়ে বেরোত, সে সময়গুলোর কথা এখন চিন্তাই করা যায় না। তখন প্রকাশনীর সংখ্যা ছিল এখনকার তুলনায় অনেক কম। লেখকের সংখ্যাও কম। কিন্তু মেলার দর্শনার্থীর সংখ্যা শতকরা হিসেবে তেমন কম ছিল না। তবে তখনকার বইমেলার চারিত্রটাও ছিল আড়ং টাইপ। বাংলা একাডেমির ভেতরে বহেড়াতলায় লিটল ম্যাগের সঙ্গে বিশাল প্যান্ডেলের নিচে খাবারদাবারের দোকান, একাডেমির নিজস্ব ক্যান্টিনে খাওয়া দাওয়া, পুকুরের উলটো দিকে রেস্টুরেন্ট, বাইরে দুদিকের ফুটপাতে অসংখ্য বইয়ের দোকান, অডিও ক্যাসেটের দোকান, ভ্যানে ভ্যানে মুরলি নিমকি মুড়ি-মুড়কি বাদাম ভাজা, মাটিতে চাদর পেতে চুড়ি ফিতা আয়না কিলিপ, দা-বঁটি বেলনপিড়ি। পুরোদস্ত্তর মেলা! স্টলে স্টলে দেশের গান, ভাষার গান, আবৃত্তি বক্তৃতা! আমরা প্রথমে গাদাগাদি করে এক গেট দিয়েই ঢুকে যেতাম। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বা একুশে ফেব্রুয়ারিতে মানুষের মাথা মানুষে খায় অবস্হা দাঁড়াত। ড. হুমায়ুন আজাদ যে বছর মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হলেন তার পরের বছর থেকে নিরাপত্তার জন্য গেটে মেটাল ডিটেক্টর বসল। তখন তো মেলায় ঢোকার জন্য মানুষের লাইন প্রায় বারডেম হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়ে আবার সাপের লেজের মতো ঘুরে আসত! স্টলগুলোর চেহারাও সাদামাটাই ছিল। খ্যাতনামা স্টলগুলো মোটামুটি দুই ইউনিটের বরাদ্দ পেতো, অন্যগুলো এক ইউনিট। তিন চার ইউনিট খুব কমই। মানুষ আসত মূলত বই কিনতে। আর সময়টাকে স্বাদু করতে একটু খাওয়া দাওয়া। এ ছাড়া আর করবেই-বা কী! ঘোরাঘুরির তো জায়গা তেমন নেই! লেখককুঞ্জ বলে কবি-সাহিত্যিকদের একটা বসার জায়গা হলো আরো পরে। সেটাও বেশির ভাগই বেদখল হয়ে যেত।
সেই এক মুঠো প্রাঙ্গণের মধ্যে উপচে পড়া ভিড়ের ধুলোমাখা হট্টমেলা বইমেলা এখন আর নেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার পর মেলা প্রতি বছর নানা পরিকল্পনায় নিত্য নতুন ঢঙে সেজে উঠছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রয়োজন বাড়ছে সেই সঙ্গে বাড়ছে শোম্যানশিপ। প্রচারণার নিত্য নতুন কৌশল। এখন বইয়ের স্টল তিন ছাড়িয়ে চার, পাঁচ ইউনিটে গেছে। এসেছে প্যাভিলিয়ন সংস্কৃতি। এক একটা স্টল নির্মাণশৈলীতে এনেছে নতুনত্ব। যেন সবাইকে ছাড়িয়ে তাকেই দেখে মানুষ। যুক্ত হয়েছে একাধিক মিডিয়া, টিভি চ্যানেল স্টুডিও। প্রতিদিন সেখানে নতুন বইয়ের খবর বা লেখকের সাক্ষাত্কার প্রচারিত হচ্ছে। এখন কোনো কোনো প্রকাশকও তার প্রকাশনীর স্টলের ভেতরে অনলাইন লাইভ স্টুডিও চালু করেছেন। চালু হয়েছে লেখক বলছি মঞ্চ, মোড়ক উন্মোচন মঞ্চ। মানুষের হাতে হাতে এখন মোবাইল ফোন। ছবি তোলা,সেলফি তোলা বর্তমান সময়ের একটা ট্রেন্ড। বইমেলায়ও তাই বিয়ে বাড়ির মত ফটো সেট তৈরি হচ্ছে। বর্ণাঢ্য জাঁকজমকে বইমেলা এখন ঝকমক করে। এখন বইমেলার উদ্দেশ্য আর বই কেনাবেচার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আলোচনা সেমিনার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি মিলিয়ে এখন তা যেমন হয়েছে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তেমনি হয়েছে একটু সুস্হ সুন্দর পরিবেশে ঘুরে ফিরে বেড়ানোর জায়গা। অনেকেই এ ব্যাপারটিকে সমালোচনার চোখে দেখেন। মানুষ তো বই কিনতে আসে না, আসে ঘুরতে, ছবি তুলতে, প্রেম করতে! তো আসুক না! এসব তো মন্দ বিষয় না! বইপাড়ায় এসে ঘোরাঘুরি, গল্পগুজব, প্রেম, ছবি তোলাতুলি হলে খারাপ কী? এসব হতে হতে যে হাতে বইয়ের প্যাকেট যে উঠে আসবে না তা তো নয়! ধানমমন্ডি লেকের পাড়ে এসব হলে তো আর বই কেনার সুযোগ থাকবে না! আর পাবলিক বই না কিনলে প্রতিদিন মেলায় শত শত নতুন বই কী করে আসে? প্রকাশকরাই-বা ছাপেন কেন? সবাই কি পকেটের পয়সা দিয়ে বই ছাপে? মেলা শেষে যে বই বিক্রির লক্ষকোটি টাকার হিসেব বেরিয়ে আসে, সেটা কিভাবে? ভালো বই মন্দ বই পরের কথা। বেচাবিক্রি তো হয়? সুতরাং গলা শুকানোর দরকার নেই। বইমেলা একাধারে জ্ঞানের মেলা আর প্রাণের মেলা হলে দোষ কোথায়! প্রাণকে প্রাণবন্ত রাখার জন্য বইমেলা যদি মানুষকে আশ্রয় দেয় সে তো ভালো!