লক্ষ বছর আগে মানুষ যখন একে অন্যের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে, তখন থেকেই মানুষের মধ্যে ভাষণ বা বক্তৃতা দেওয়ার প্রবণতা ছিল বলে গবেষকেরা অনুমান করেন। মানুষ যখন সমাজবদ্ধ হতে শুরু করে, তখনই সেই সমাজের নেতৃত্ব নেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। একসময় পেশীশক্তি দ্বারাই সমাজপতি নির্ধারিত হতো। সেই সমাজপতিদের অন্যায়, অবিচারের প্রতিবাদ করতেন জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানেরা। যারা প্রতিবাদ করতেন, তাঁদের ওপর নেমে আসতো সমাজপতিদের খড়গ। মহামতি সক্রেটিস থেকে আমাদের বাঙালিদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ সেই বাস্তবতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আচার-আচরণ পরিবর্তিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ভাষণ বা বক্তৃতারও ধরণ পাল্টাতে থাকে। সক্রেটিসকে তাঁর দর্শন, জ্ঞান, সমাজপতিদের সমালোচনা ও তরুণ সমাজকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯ সালে।
বিভিন্ন বক্তৃতায় যে কথাগুলো তিনি বলতেন, তা আজও ইতিহাস হয়ে রয়েছে। ‘নিজেকে জানো’, ‘মৃত্যুই হলো মানুষের সর্বাপেক্ষা বড় আশীর্বাদ’, ‘তুমি কিছুই জানো না এটা জানাই জ্ঞানের আসল অর্থ’, আর মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তাঁর বলে যাওয়া, ‘আমি মারা যাচ্ছি, তুমি বেঁচে থাকবে। কোনটি বেশি ভালো, তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।’ মৃত্যুর ২৪০০ বছর পর আজও তাই সক্রেটিস প্রাসঙ্গিক। সেই সক্রেটিসকে সত্য কথা বলার জন্য তৎকালীন শাসকেরা বা সমাজপতিরা হেমলক পানে আত্মহননে বাধ্য করেছিল। সক্রেটিস পিছপা হননি হেমলক পানে, নতজানু হয়ে সত্যকে অস্বীকার করেননি। সক্রেটিস মরে গেছেন, কিন্তু তাঁর সত্য ভাষণ এখনও মানুষের কাছে অবিনশ্বর হয়ে আছে।
পেরিকলস ৪৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পেলোপোনেশিয়ান যুদ্ধে নিহতদের সম্মান জানাতে একটি শোকসভা অনুষ্ঠানে প্রকাশ্য একটি বক্তৃতায় বলেন, ‘‘সমস্ত পৃথিবী বিখ্যাত মানুষের সমাধিক্ষেত্র কেবলমাত্র মাতৃভূমির স্মারক চিহ্ন বা প্রস্তর ফলকের মাধ্যমে তাদের স্মরণে রাখে না, বিদেশেও তাদের অলিখিত স্মারক থাকে, যা পাথরে নয় মানুষের হৃদয়ে খোদাই করা থাকে’’। ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজার ফার্সালাসে পম্পেইর বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে তাঁর লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় বলেন, ‘‘সবার আগে আমি জানাতে চাই ,আপনারা বিজয় অথবা মৃত্যু যেকোনো একটিকে বেছে নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার আগে আপনাদের তাবুর প্রাচীর ভেঙে ফেলবেন এবং গর্ত ভরাট করে ফেলবেন যাতে আমরা তাদের পরাজিত করতে না পারলেও আমাদের আশ্রয়ের কোন জায়গা না থাকে। যাতে শত্রুরা দেখতে পায় আমাদের কোনো তাবু নেই এবং জানে যে আমরা তাদের তাবুতেই আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি’’।
১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে সালাদ্বীন হাতিনের যুদ্ধে বক্তব্যে বলেন, ‘‘আল্লাহ’তালা যদি জেরুজালেম থেকে শত্রুদের বিতাড়িত করতে আমাদের সহায় হন, তাহলে এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের এবং খুশির বিষয় হবে। একানব্বই বছর ধরে জেরুজালেম শত্রুর অধীনে রয়েছে। এতো বছর ধরে আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে কিছুই পাননি, এখন সময় এসেছে তাঁকে কিছু দেয়ার। সময়ের সাথে সাথে মুসলমানরা উদ্যোম হারিয়ে ফেলেছে। সময় বয়ে গিয়েছে, সেই সাথে কয়েক প্রজন্ম এসে চলে গেছে। শত্রুরা সেখানে নিজেদেরকে আরও শক্তিশালী করেছে। এখন আল্লাহ এর পুনরুদ্ধারের সম্মান রেখেছেন আমাদের জন্য, আইয়ুবী সম্প্রদায়ের জন্য। এর জন্য আমাদের সকলকে আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত’’।
১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে হার্নান কর্টেস কিউবা ছেড়ে যাওয়ার আগে তার দলের উদ্দেশ্যে বলেন’ ‘‘মহান জিনিসগুলো শুধুমাত্র পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত হয় এবং অলসতার পুরষ্কার কখনও গৌরবময় হতে পারে না’’।
১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে টিলবারের সৈন্যদের উদ্দেশ্যে এলিজাবেথ বলেন, ‘‘প্রিয় জনতা আমি আপনাদেরকে এটা আশ্বস্ত করতে চাই যে বিশ্বাসঘাতক হয়ে আমি বেঁচে থাকতে চাই না। চলুন অত্যাচারীদের ভয় দেখাই; আমি মনে প্রাণে চেয়েছি সৃষ্টিকর্তার পরে, আমার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে প্রজাদের সুরক্ষা আর মঙ্গলে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে। আর এর জন্য আমি আপনাদের সামনে এসেছি, যেটা আপনারা দেখছেন, আমি কোন বিনোদন বা আত্মপ্রণোদনার জন্য আসিনি। এসেছি সংকল্প বদ্ধ হয়ে এই উত্তপ্ত দামামার মাঝে। আপনাদের সকলের মাঝে বেঁচে থাকতে বা মরতে, আমার ঈশ্বরের জন্য, আমার রাজ্যের জন্য এবং আমার প্রজাদের জন্য, আমার বংশের সম্মানের জন্য, এমনকি প্রতিটি ধুলিকনার জন্য। আমি জানি আমার শরীর একজন অবলা দুর্বল নারীর। কিন্তু আমার হৃদয়ের ক্ষুধা একজন রাজার মতোই এবং একজন ইংল্যান্ডের রাজার মতোই। পার্মা বা স্পেনের প্রতি তীব্র অবজ্ঞা আর ঘৃণা বা ইউরোপের কোন রাজপুত্র, যে আমার সম্রাজ্যে আক্রমণের সাহস করবে, যেটা আমার মধ্যে অসম্মানের সৃষ্টি করবে, তখন আমি নিজেই অস্ত্র তুলে নেবো। আমিই হবো আপনাদের সেনাপতি, বিচারক এবং আপনাদের প্রতিটি গুণের পুরস্কারদাতা’’।
১৭১৬ সালে জেমস ফ্রান্সিস এডওয়ার্ড পার্থে তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘‘আমি আপনাদের বলছি, বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনাদের করা উচিৎ সৃষ্টিকর্তার পরে আপনাদের নিজেদের মতামত ও সিদ্ধান্তের উপরে আস্থা রাখা’’।
১৭৭৫ সালে ভার্জিনিয়ার রিচমন্ড এর সেন্ট জনস চার্চে হেনরি বলেন, ‘‘ভদ্রমহাশয়গণ আসলে কি চাচ্ছেন আপনারা? তাদের কি আছে? জীবন কি এতই প্রিয়, নাকি শান্তি এতটাই মধুর, যা শৃঙ্খল ও দাসত্বের দামে কেনা যায়? এটা নিষিদ্ধ, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান! আমি জানি না অন্যরা কি গতিপথ গ্রহণ করবে; কিন্তু আমার জন্য, হয় স্বাধীনতা দাও নয় আমাকে মৃত্যু দাও!’’
১৯৪০ সালে চার্লস ডি গল বিবিসিতে ফ্রান্সের জনগণের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণে বলেন, ‘‘আজ যে যান্ত্রিক শক্তি আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে পরাস্ত করতে চাইছে, অদূর ভবিষ্যতে এর থেকে বড় যান্ত্রিক শক্তি আমাদের বিজয় নিশ্চিত করবে। বিশ্বের ভাগ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আমি ডি গল, বর্তমানে লন্ডনে, সকল ফরাসী অফিসার এবং জনগণকে সশস্ত্র বা অস্ত্রবিহীন আহবান জানাই, যারা বর্তমানে ব্রিটেন এর মাটিতে আছেন বা ভবিষ্যতে থাকবেন। আমি অস্ত্র কারখানার সকল প্রকৌশলী এবং দক্ষ কর্মীদের আমার সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য আহবান জানাচ্ছি যারা বর্তমানে ব্রিটেন এর মাটিতে আছেন বা ভবিষ্যতে থাকবেন। যাই ঘটুক না কেন, ফরাসি প্রতিরোধের শিখা অবশ্যই জ্বলতে থাকবে’’।
১৯৪৪ সালে মাও সেতুং একটি বক্তব্যে বলেন, ‘‘মাউন্ট তাইয়ের চেয়েও গুরুতর হল মানুষের জন্য জীবন দেয়া ,কিন্তু ফ্যাসিস্টদের জন্য কাজ করা এবং শোষক ও নিপীড়নদের মৃত্যু, পালক থেকেও অনেক হালকা । সহচরী ঝাং সাইড মানুষের জন্য মারা গিয়েছিলেন এবং তার মৃত্যু সত্যিই মাউন্ট তাইয়ের চেয়েও গুরুত্বর’’।
১৯৪৫ সালে হো চি মিন হ্যানয়ের বাদিন স্কোয়ারে ভিয়েতনামের স্বাধীনতার ঘোষণার বক্তব্যে বলেন, ‘‘তারা স্কুলের চেয়ে কারাগার বেশি তৈরি করেছে। তারা আমাদের দেশপ্রেমিকদের নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে; তারা আমাদের আন্দোলনকে রক্তের নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে, তারা আমাদের মেরুদণ্ডটাকেই ভেঙে দিয়েছে, আমাদের জনগণকে দরিদ্র করেছে এবং আমাদের জমি ধ্বংস করেছে। সমস্ত ভিয়েতনামী জনগণ, একটি সাধারণ উদ্দেশ্য দ্বারা প্রাণবন্ত, আর তা হল, তাদের দেশ পুনরুদ্ধার করার ক্ষেত্রে, ফরাসি ঔপনিবেশিকদের যে কোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তিক্ত পরিণতি পর্যন্ত লড়াই করার জন্য তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’’।
১৯৮৭ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান তার বক্তব্যে বার্লিন ওয়াল সম্পর্কে বলেন, ‘‘জেনারেল সেক্রেটারি গর্বাচেভ, আপনি যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নতি চান, উদারীকরণ চান, তাহলে চলে আসুন এই গেটের কাছে। মি. গর্বাচেভ, খুলে দিন এই দরজা। মি. গর্বাচেভ, চিঁড়ে ফেলুন এই দেয়াল’’।
পৃথিবীতে ইতোপূর্বে যতগুলো রাজনৈতিক ও শোষণমুক্তির ভাষণ আলোচিত হয়েছে তার মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ ১৯৭১ সালের ভাষণটি একটি বিশেষ কারণে মহোত্তম ভাষণের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে বলে বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন। কারণ, অন্যান্য ভাষণগুলি ছিল গুছিয়ে কথা বলার মতো যুদ্ধ থামাও, যুদ্ধ করো ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল ২৩ বছরের জনগণের মনের ভেতরে চেপে থাকা কথারই তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশ। মাঠ প্রকম্পিত করা আন্দোলিত উচ্চারণগুলো শোষণ বঞ্চনার নির্যাস হিসেবে দেখা যায় গবেষকদের আলোচনায়।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গের ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসে অন্যতম গণতান্ত্রিক ভাষণ হিসেবে চিরস্মরণীয়- এই কথাটি বলা হয়ে থাকে। ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর আমেরিকার চরম দুঃসময়ে পেনসিলভেনিয়ার গেটিসবার্গে তিনি এ ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষণের মূল তিনটি উক্তি- জনগণের সরকার, জনগণ দ্বারা সরকার ও জনগণের জন্য সরকার এই জন্য তিনি জগদ্বিখ্যাত হয়ে আছেন। কিন্তু ওই ভাষণ ছিল দেশের অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতার বিরুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাষণটি ছিল শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা, ষড়যন্ত্র আর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। আব্রাহাম লিংকনের ভাষণটি ছিল মাত্র তিন মিনিটের। আর বঙ্গবন্ধু মুজিবের ভাষণটি ছিল ১৮ মিনিটের। আব্রাহাম লিংকনের ভাষণটি তিন মিনিট ধরে মানুষ নিস্তব্ধতায় শুনেছে মন দিয়ে, আর বঙ্গবন্ধু মুজিবের দীর্ঘ আঠারো মিনিটের ভাষণটি দশ লক্ষ মানুষ শুনেছে। পিনপতন নীরবতায় মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যেকটি উচ্চারণ হৃদয় দিয়ে ধারণ করেছে। ভাষণ শেষে একটিই দাবি উঠেছিলো- বাংলাদেশ স্বাধীন কর। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে একটি নির্যাতিত জাতির স্বাধীন হয়ে ওঠার সংকল্প প্রতিষ্ঠিত হয়।
ওয়াশিংটন ডিসির লিংকন মেমোরিয়াল চত্বরে মার্টিন লুথার কিং এর ১৯৬৩ সালের কালজয়ী ‘I have a dream’ ভাষণটি প্রথমদিকে লিখিত বক্তব্য আকারে শুরু হলেও এর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মর্মস্পর্শী শেষের অংশটি ছিল স্বত:স্ফূর্ত। ১৭ মিনিটের ভাষণে শব্দ ছিল ১৬৬৭। আব্রাহাম লিংকনের Gettysburg Addressএর শব্দ সংখ্যা ২৭২ সময় ৩ মিনিটেরও কম।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) মঞ্চে উঠে চিরাচরিত ভঙ্গিতে ‘ভাইয়েরা আমার’ সম্বোধনের মাধ্যমে শুরু করেন তাঁর বক্তৃতা। ১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি মোট ১১০৮টি শব্দ উচ্চারণ করেন। মিনিটে গড়ে ৪৮ থেকে ৫০টি শব্দ বের হয় তার মুখ দিয়ে। বক্তার মুখ নিঃসৃত শব্দ যদি মিনিটে ১২০টি বের হয় মানে প্রতি সেকেন্ডে ২টি করে উচ্চারিত হয় মানুষ তাতেই সে বক্তব্য স্পষ্ট বুঝতে পারে। তবে বঙ্গবন্ধু তেমন ব্যাকরণ মেনে সেদিন বক্তৃতা করেননি। তিনি তখন যা করেছিলেন সেটি তাঁর নিজের পরিমাপ। তিনি মানুষকে বুঝতেন। তিনি জানতেন বাঙালি কথা-বার্তা কাঠিন্যের নিয়মে শুনতে অভ্যস্ত নয়। বাঙালি বঙ্গবন্ধুর কথার সাথে পরিচিত। ২৩ বছরে বাঙালি বঙ্গবন্ধুর অনেক ভাষণ শুনেছে। বঙ্গবন্ধুও তাঁর বক্তৃতায় শব্দ চয়ন ও প্রক্ষেপণে এমন যত্নশীল থাকতেন যেকোনো মানুষই বক্তৃতার একটি কথাও না শুনে থাকতো না। পুরোটাই শুনতো খুব মনোযোগ নিয়ে। মাঠের বক্তৃতায়ও বঙ্গবন্ধু কোন অহেতুক কথার ফুলঝুরি ছোটাতেন না। জনতা তাই তাঁর কথা শুনতো-বুঝতো আর হৃদয়ে ধারণ করতো।
শাব্দিক গুরুত্বে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে একটি সুনির্দিষ্ট প্রবাহানুসারে কথাগুলো উচ্চারিত হয়েছে বলে প্রমাণ মেলে যেমন, শুরুতে ইতিহাস, মধ্যম পর্যায়ে অত্যাচার ও অন্যায়ের বিষয়ের পাশাপাশি সাবধান করার সাথে আলোচনার আহ্বান এবং উপসংহারের দিকে দেশের জনগণের প্রতি দিক-নির্দেশনামূলক কথাবার্তাগুলো রয়েছে। শেষের কথাটি ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যে সংলাপ শোনার জন্যেই সেদিন মুখিয়ে ছিল সারাদেশ। ‘জয় বাংলা' বলে ভাষণটি শেষ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, পরবর্তীতে সেই স্লোগানটিই বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের যুদ্ধ হুঙ্কারে পরিণত হয়েছিল। ইতিহাসের স্বাক্ষীবাহী ঐতিহাসিক ৭ মার্চের মুক্তি প্রস্তুতির ভাষণের পরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে দ্য নিউজউইক ম্যাগাজিন ৫ এপ্রিলে প্রকাশিত সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বা ‘রাজনীতির কবি' বলে আখ্যায়িত করেছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দেয়া ৭ মার্চের ভাষণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে ভাষণটির রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিকটি সমান্তরাল আবিষ্কৃত হয় । সেদিন শুধুমাত্র একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবেই বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণটি দেননি। বাঙালির মুক্তির জন্য কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন সেদিন থেকেই কার্যত মুক্তি শপথে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। সেই বক্তৃতার মাধ্যমেই বাঙালি সেদিন মুক্তির স্বপ্নে ঝাঁপ দিয়েছিল। লক্ষ্য করা যায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটি পদক্ষেপ ও বাণী ছিল বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার একমাত্র নিয়ামক।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের পর দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীতে শোষিত নিপীড়িত নির্যাতিত মানব জাতিকে রক্ষার জন্য এমন আর কোন ভাষণ বিশ্ববাসী অবলোকন করে নাই। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব মানবতা মুক্তির সংগ্রামে হাজার বছর আলো ছড়াবেই। জয় বাংলা।
মো. কামরুল আহসান তালুকদার পিএএ,
উপমন্ত্রীর একান্ত সচিব (উপসচিব), পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়