শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মানুষ কষ্টভোগ করে মূল্যস্ফীতির কারণে

আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২২, ০৭:৫৫

বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে প্রায় প্রতিদিন। করোনার অভিঘাতে সারা বিশ্বেই উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে বিভিন্ন পণ্যের। তাতে বেড়েছে পণ্যমূল্য। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঐ মূল্যবৃদ্ধিকে আরো উস্কে দিয়েছে। তাতে জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ঢেউ এসে লেগেছে বাংলাদেশেও।

চাল-ডাল-ভোজ্যতেল-পেঁয়াজ-চিনিসহ সব পণ্যই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এমন বাস্তবতায় সরকার খোলাবাজারে টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে গত ৬ মার্চ থেকে ঢাকায় এবং ১৫ মার্চ থেকে সারা দেশে ১ কোটি পরিবারের মধ্যে বিক্রি করা হচ্ছে টিসিবির হ্রাসকৃত মূল্যের পণ্যসামগ্রী। তাতে উপকৃত হবে প্রায় ৫ কোটি লোক। এটি ভালো পদক্ষেপ। তবে এর মাত্রা ও পরিসর নিয়ে প্রশ্ন আছে। ইতিমধ্যেই ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকসেল কেন্দ্রে ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য পেতে ভিড় করছেন শত শত মানুষ। বাজার মূল্যের চেয়ে সাশ্রয়ী দামে পণ্য কিনে নিম্নআয়ের মানুষের পাশাপাশি লাইনে দাঁড়াচ্ছেন মধ্যবিত্তরাও। চিনির দাম খোলা বাজারে ৮৫ টাকা কেজি। টিসিবি দিচ্ছে ৫৫ টাকায়। সয়াবিন তেল প্রতি লিটার খোলা বাজারে ১৬৮ টাকা, টিসিবি দিচ্ছে ১২০ টাকায়। পেঁয়াজ বাজারে ৬০ টাকা কেজি, টিসিবির নির্ধারিত মূল্য প্রতি কেজি ৩০ টাকা। স্বল্পমূল্যে পণ্য ক্রয়ের জন্য টিসিবি ট্রাকের পেছনে পড়ে যায় ক্রেতাদের লম্বা লাইন। কেউ কেউ ২/৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করে সস্তা মূল্যে পণ্য কিনতে পারেন, অনেকেই পারেন না। কোনো কোনো লাইনে সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা। এমনকি হাতাহাতিও হয়। এই পরিস্হিতি এড়ানোর জন্য ক্রেতাদের অমোচনীয় কালিতে নম্বর বসিয়ে দিচ্ছেন ডিলারের কর্মীরা। তবু সিরিয়াল আসার আগেই বিক্রি হয়ে যায় সব পণ্য। অনেকেই ফিরে যায় খালি হাতে। রাজধানীর মিরপুর, জাতীয় প্রেসক্লাব, কুড়িল, বাড্ডাসহ সব ট্রাকসেল কেন্দ্রে একই চিত্র। মানুষের আয় কমে গেছে করোনার অভিঘাতে। অনেকে হারিয়েছেন চাকরি। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক দোকানপাট, অনানুষ্ঠানিক ক্ষুদ্র শিল্প-কারখানা। ফলে অতি কষ্টে আছেন সাধারণ মানুষ। তাই তারা সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে এসে লাইন করে দাঁড়াচ্ছেন ট্রাকের পেছনে।

শুধু রাজধানী ঢাকায় নয়, সস্তা দামে পণ্য কেনার ভিড় আছে দেশের বিভিন্ন পৌর এলাকাতেও। আত্মসম্মানের কথা না ভেবে ওএমএসের লাইনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন গরিব, মধ্যবিত্ত সবাই। সহযোগী একটি দৈনিকে প্রকাশ, নির্ধারিত সংখ্যকের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ মানুষ এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন সাশ্রয়ী মূল্যের পণ্য কিনতে। চাল ৩০ টাকা কেজি, আটা প্রতি কেজি ১৮ টাকা। বাজারে প্রায় ৫০ টাকা ও ৪৫ টাকা। তাই ওএমএসের দোকানগুলোতে ভিড় বেড়েই চলেছে। ফলে অনেকেই পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে এগিয়ে যাচ্ছেন খোলা বাজারের দিকে। সেখানে দাম বেশি, হতাশা বেশি। সেই সঙ্গে আছে তীব্র মনোকষ্ট।

সরকারের একজন মন্ত্রী বলেছেন, গত ১৩ বছরে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় চারগুণ। মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৯১ ডলার। নিঃসন্দেহে এটা ভালো অর্জন। কিন্তু আয়ের এই প্রবৃদ্ধি কি সবার ভাগ্যেই জুটেছে সমানভাবে? আসলে কারো উন্নতি হয়েছে, কারো হয়নি। ফলে বৈষম্য বেড়েছে।

সরকারের একজন মন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে সহনীয় পর্যায়ে আছে মূল্যস্ফীতি। বিবিএসের হিসেবে মূল্যস্ফীতির হার ৫.৮৬ শতাংশ। পৃথিবীর অনেক দেশে এই হার ২ শতাংশের বেশি নয়। কোনো কোনো দেশে তা ১ শতাংশেরও কম, এমনকি নেতিবাচক। প্রশ্ন হচ্ছে সহনীয়ের মাত্রা নিয়ে। বেসরকারি গবেষণা সংস্হা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলেছে, সরকারিভাবে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে তাতে বাস্তবতার প্রতিফলন নেই। ঐ সংস্হাটি জানুয়ারি মাসে শহর এলাকার চার শ্রেণীর মানুষের জীবনমানের তথ্য হিসাব করে মূল্যস্ফীতির হার ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং গ্রামে ১১ দশমিক ২১ শতাংশ নির্ণয় করেছে। ফেব্র~য়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি শহরাঞ্চলে ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ১২ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০১১ সালের পর এত বেশি মূল্যস্ফীতি (১১.৩৮ শতাংশ) আর কখনো অনুভূত হয়নি। দেশের সাধারণ মানুষ জাতীয় আয় বৃদ্ধির সুখ তত বেশি অনুভব করে না, যত বেশি কষ্টভোগ করে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেয় তাদের ক্রয়ক্ষমতাকে। তাই টিসিবির সস্তা পণ্য ক্রয়ের জন্য ট্রাকের পেছনে তাদের লাইন হয় দীর্ঘ।

বাংলাদেশে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম ইতিমধ্যেই বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তা আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত ৮ মার্চ একটি দৈনিকে প্রকাশ, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন ১৩৫ থেকে ১৪০ ডলারে ওঠানামা করছে প্রতি ব্যারেল। ২০০৮ সালের পর এটাই জ্বালানির সর্বোচ্চ দাম। গত বছরের অক্টোবর থেকেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে বিশ্ব বাজারে। এর জেরে গত বছরের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয় ২৩ শতাংশ। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ভোক্তা পর্যায়ে নির্ধারণ করা হয় প্রতি লিটার ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা। বাড়ানো হয় লিকুইড গ্যাসের দামও। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। সামনে তা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। জ্বালানি ছাড়া বিশ্ব বাজারে সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম বেড়েছে টনপ্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ ডলার। এর প্রভাবে ভোজ্যতেলের দাম আরো বাড়তে পারে বাংলাদেশে। গমের দাম ইতিমধ্যেই মানভেদে টনপ্রতি ৪০০ ডলার থেকে বেড়ে ৫০০ ডলারে উপনীত হয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্ব বাজারে গম সরবরাহকারী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বড় গম আমদানিকারক একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশে গমের দাম আরেক দফা বেড়ে যেতে পারে। অপর দিকে জ্বালানি তেলের দামের পাশাপাশি গ্যাস ও বিলেতি সারের দাম প্রায় শত ভাগ বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে কৃষির উত্পাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে। তাতে নিরুত্সাহিত হতে পারেন দেশের কৃষক। ফলে বিঘ্নিত হবে খাদ্যশস্যের উত্পাদন। এমন পরিস্হিতিতে জ্বালানি তেল ও সারের দাম সমন্বয় না করে ভর্তুকি বাড়ানো হবে যুক্তিসংগত।

বাংলাদেশে চাল, গম, ডাল, তেল, পেঁয়াজ ও চিনির মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ দেশে এসব পণ্যের ঘাটতি এবং আমদানিনির্ভরতা। চাল ও গমের ক্ষেত্রে গত বছর আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৭ লাখ টন। পেঁয়াজ, ডাল ও ভোজ্যতেল আমদানির পরিমাণ যথাক্রমে মোট প্রয়োজনের প্রায় ৩০, ৫০ ও ৯০ শতাংশ। চিনির প্রয়োজন মেটাতে হয় পুরোটাই আমদানি করে। ফলে বিশ্ব বাজারের মূল্য পরিস্হিতি বাংলাদেশকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। এ অবস্হা থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের কৃষির উত্পাদন বাড়াতে হবে। আমদানি প্রতিস্হাপন করতে হবে। বর্তমান অনিশ্চিত বিশ্ব পরিস্হিতিতে অস্হির বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য অভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। করোনার সংক্রমণ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যমূল্য আরো একধাপ বেড়েছে। করোনার পর জ্বালানি তেলের দাম ৮৬ ডলারে উঠেছিল প্রতি ব্যারেল। পরে আবার কমে তা নামে ৬৮ ডলারে। সম্প্রতি যুদ্ধের কারণে আবার ব্যারেল প্রতি ১৩৫ থেকে ১৪০ ডলারে উঠেছে তেলের দাম। গমের দাম বেড়েছে প্রায় ৩২ শতাংশ। বেড়েছে অন্য পণ্যসামগ্রীর দামও। ফলে আমাদের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপর দিকে রেমিট্যান্স আয় কমেছে। রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে। এটাও মূল্যস্ফীতির সহায়ক। বিভিন্ন পণ্যের অভ্যন্তরীণ উত্পাদন বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু উত্পাদন বৃদ্ধির স্ফীত পরিসংখ্যান দিয়ে বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে এখন চাল, ডাল, তেল আর চিনির মূল্য বৃদ্ধি নিয়েই সবাই উদ্বিগ্ন। এ সম্পর্কেই আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে বেশি। অন্যদিকে শিশুখাদ্যের দাম যে নীরবে বাড়ছে লাগামহীনভাবে সে কথা কেউ তেমনভাবে বলছে না। গুঁড়া দুধ, ফুড সাপ্লিমেন্ট, কমপ্লেক্স, চকোলেটসহ বিভিন্ন বেকারি পণ্যের দামও এখন বেশ চড়া। দ্রুত বাড়ছে সাবান, সোডা, প্রসাধনী, টুথপেস্ট এবং টিসু্য পেপারের দাম। মাছ, মাংস, ডিম, পোল্টি্র এবং এদের থেকে উত্পাদিত খাদ্যপণ্যের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে অস্বাভাবিক হারে। অবিলম্বে এর লাগাম টেনে ধরা দরকার। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে নিয়মিত মনিটরিং জোরদার করা দরকার। ক্ষেত্রবিশেষে ভ্যাট, ট্যাক্স কমিয়ে এবং ভর্তুকি দিয়ে এগুলোর বাজার মূল্য স্হিতিশীল করা আবশ্যক। আমদানিকৃত পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কহার ও ভ্যাট যৌক্তিকীকরণ এখন সময়ের দাবি।

সামনে রোজা আসছে। এ সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাড়তি মূল্য সাধারণ ভোক্তাদের জন্য অসহনীয় কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের ধর্মে আছে রোজার মাসে শ্রমিকের কাজ লাঘব করে দেওয়া। লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা। তাই সরকারের দায়িত্ব হলো জনদুর্ভোগ কমাতে বাজারদর স্হিতিশীল রাখা।

লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও শিক্ষাবিদ

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন