শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী

আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২২, ১০:০৯

এ পর্যন্ত ইউক্রেন যুদ্ধ চীনের জন্য বিরাট শিক্ষণীয়। রাশিয়ার মতো চীনও গত এক দশকে আপাতদৃষ্টিতে উচ্চ প্রযুক্তির সামরিক বাহিনী গড়ে তুলেছে, কিন্তু তাদের কোনো যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই। রাশিয়ান বিমানবাহিনীর করুণ কর্মক্ষমতা সম্ভবত পিপলস লিবারেশন আর্মি এয়ার ফোর্স দ্বারাও প্রতিফলিত হবে, যাদের একইভাবে জটিল বিমান অপারেশন পরিচালনা করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

আমি উত্তর মেসিডোনিয়ার স্কোপজে থেকে লিখছি। এখানে আমি গত এক সপ্তাহ থেকে (এই লেখা প্রকাশিত হয়েছে ১০ মার্চ ২০২২, তার এক সপ্তাহ আগে থেকে) আমাদের লিডারশিপ একাডেমি ফর ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে একটি কোর্সের ওপর ক্লাস নিচ্ছি। সব তথ্যই সহজলভ্য বলে এখানে থেকেও ইউক্রেন যুদ্ধের গতিবিধির ওপর নজর রাখা কঠিন কিছু নয়। ব্যতিক্রম শুধু সময়ের পার্থক্য। আমি একটি সন্নিহিত টাইম জোন বা সময় অঞ্চলে আছি। বাস্তবতা হচ্ছে, ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পূর্ব ইউরোপের বলকান এলাকায় পুতিনের পক্ষে বেশি জনসমর্থন রয়েছে। এর বড় কারণ সার্বিয়া। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম ও বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক এই সার্বিয়া থেকেই মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়। তার পরও আমি এ থেকে আমার নজর ফিরিয়ে নিচ্ছি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করছি:

১. ইউক্রেনে রাশিয়া সরাসরি পরাজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার যুদ্ধ পরিকল্পনায় পাওয়া যাচ্ছে অদক্ষতার পরিচয়। এই যুদ্ধ পরিকল্পনা ভুল ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাদের ধারণা ছিল, ইউক্রেনের জনগণ রাশিয়ার পক্ষাবলম্বন করবে এবং রাশিয়ার আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ভেঙে পড়বে। রাশিয়ার সৈন্যরা অতিরিক্ত গোলাবারুদ ও রেশনের পরিবর্তে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে বিজয় কুচকাওয়াজের জন্য বিশেষ ইউনিফর্ম বহন করছিল। পুতিন এই অপারেশনে তার গোটা সামরিক বাহিনীকে এ কথার ওপরই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছেন, কিন্তু বিপর্যয়কর যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ডাকা যায় এমন বিশাল রিজার্ভ ফোর্সের ব্যবস্থা রাখেননি। ফলে রাশিয়ার সৈন্যরা ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরের বাইরে ক্রমাগতভাবে ইউক্রেনীয় আক্রমণের মুখে আটকা পড়েছে এবং তারা জ্বালানি ও খাদ্য সরবরাহে নানা সমস্যা ও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছে।

২. রাশিয়ার সৈন্যদের পতন হতে পারে আকস্মিকভাবে। এই পতন হতে পারে অত্যন্ত বিপর্যয়কর। যুদ্ধের ময়দানে রাশিয়ার সেনাবাহিনী এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে, যেখান থেকে তাদের জন্য রসদ সরবরাহ বা তাদের প্রত্যাহার করা যাবে না। এতে তাদের মনোবল ভেঙে যাবে। বিশেষ করে এটা অন্তত উত্তরাঞ্চলের ক্ষেত্রে সত্য। রাশিয়ান সেনারা তুলনামূলকভাবে দক্ষিণাঞ্চলে ভালো লড়াই করছে। কিন্তু উত্তরাঞ্চলে পতন হলে সেই অবস্থানগুলোও ধরে রাখা কঠিন হবে।

৩. এ ঘটনার আগে এই যুদ্ধের কোনো কূটনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়। এই পর্যায়ে তারা যে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে, তা বিবেচনায় নিলে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে এমন কোনো আপস ফর্মুলা নেই।

৪. এই যুদ্ধের মাধ্যমে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আবারও অকেজো বলে প্রমাণিত হলো। এক্ষেত্রে একমাত্র সহায়ক শক্তি ছিল সাধারণ পরিষদের ভোট। এই ভোট বিশ্বের খারাপ বা অপ্রত্যাশিত নেতাদের শনাক্ত করতে সহায়তা করে আসছে।

৫. নো ফ্লাই জোন ঘোষণা না করা বা পোল্যান্ডের মিগ যুদ্ধ বিমানগুলো স্থানান্তর করতে সহায়তা না করার পেছনে বাইডেন প্রশাসনের সিদ্ধান্ত উভয়ই সঠিক ছিল। তারা খুব আবেগপূর্ণ সময়ে তাদের মাথা ঠান্ডা রেখেছে। ইউক্রেনীয়রা নিজেরাই রাশিয়ানদের পরাজিত করুক এটাই তাদের জন্য অধিকতর ভালো। এতে মস্কো এই অজুহাত তোলার সুযোগ পাবে না যে, ন্যাটো তাদের ওপর হামলা করেছে। এর ফলে বর্ধিত আক্রমণ তথা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাকেও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। বিশেষ করে পোলিশ মিগ বিমানগুলো ইউক্রেনের সক্ষমতায় খুব বেশি কিছু যোগ করবে না। তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো অবিরতভাবে জেভেলিন, স্টিংগার, টিবি-২, অন্যান্য সাধারণ যুদ্ধ সরাঞ্জাম, মেডিকেল সাহায্য প্রভৃতি সরবরাহ করা এবং আন্তটেলিযোগ বাড়ানো। আমি অনুমান করছি, ইউক্রেনীয় বাহিনী ইতিমধ্যে ইউক্রেনের বাইরে থেকে পরিচালিত ন্যাটো গোয়েন্দাদের তথ্য দ্বারা উপকৃত হচ্ছে।

৬. যুদ্ধে ইউক্রেনের যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তা অবশ্যই ব্যাপক। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে রকেট ও আর্টিলারি হামলার মাধ্যমে, যা মিগ বা নো ফ্লাই জোন খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে না। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও ক্ষয়ক্ষতি বন্ধ করার একমাত্র উপায় হলো ইউক্রেনের মাটিতে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর পরাজয়।

৭. পুতিন তার সেনাবাহিনীর পরাজয় থেকে বাঁচতে পারবেন না। তিনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমর্থন লাভ করছেন। কারণ তাকে একজন শক্তিশালী বলে মনে করা হয়। তিনি নিজের অযোগ্যতা প্রমাণ করেছেন এবং জোরপূর্বক ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছেন। এরপর তাকে আর কী বলে পরিচয় দিতে হবে?

৮. ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা ইতিমধ্যে সারা বিশ্বে লোকরঞ্জনবাদী সেই সব নেতার ব্যাপক ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, যারা হামলার আগে পুতিনের প্রতি সমানভাবে সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে মাত্তেও সালভিনি, জাইর বলসোনারো, এরিক জেমুর, মেরিন লে পেন, ভিক্টর অরবান এবং অবশ্যই ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুদ্ধের রাজনীতি তাদের প্রকাশ্য কর্তৃত্ববাদী প্রবণতাকেই উন্মোচিত করেছে।

৯. এ পর্যন্ত ইউক্রেন যুদ্ধ চীনের জন্য বিরাট শিক্ষণীয়। রাশিয়ার মতো চীনও গত এক দশকে আপাতদৃষ্টিতে উচ্চ প্রযুক্তির সামরিক বাহিনী গড়ে তুলেছে, কিন্তু তাদের কোনো যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই। রাশিয়ান বিমানবাহিনীর করুণ কর্মক্ষমতা সম্ভবত পিপলস লিবারেশন আর্মি এয়ার ফোর্স দ্বারাও প্রতিফলিত হবে, যাদের একইভাবে জটিল বিমান অপারেশন পরিচালনা করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আমরা আশা করতে পারি যে চীনা নেতৃত্ব তাইওয়ানের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে কোনো নেতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের আগে এটা গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে দেখবে।

১০. আমরা আশা করি, তাইওয়ান নিজেই ইউক্রেনিয়ানদের মতো জেগে উঠবে, লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে এবং সেনাবাহিনীতে নাগরিকদের বাধ্যতামূলক নিয়োগের বিষয়টি পুনরায় ভেবে দেখবে। আসুন, আমরা অকালে পরাজিত না হই।

১১. তুর্কি ড্রোন বেস্ট সেলার হয়ে উঠবে।

১২. ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় ‘স্বাধীনতার নতুন জন্ম’কে (নিউ বাথ অব ফ্রিডম) সম্ভব করে তুলবে এবং বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা সম্পর্কে আমাদের উদ্বেগ দূর করবে। ১৯৮৯-এর চেতনা বেঁচে থাকবে।

একঝাঁক সাহসী ইউক্রেনিয়ানকে ধন্যবাদ।

লেখক: আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক

বুদ্ধিবৃত্তিক ম্যাগাজিন ‘আমেরিকান পারপাস’ থেকে অনুবাদ: ফাইজুল ইসলাম

ইত্তেফাক/এমআর

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন