শব্দদূষণ স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আপনি জানেন কি, তিন বছর বয়সের নিচে কোনো শিশুর কানে যদি খুব কাছ থেকে ১০০ ডেসিবেল শব্দ আসে, তাহলে তার শ্রবণক্ষমতা বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে?
অতি সম্প্রতি আমাদের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের এক নম্বর শব্দদূষণের সিটির তকমা পেয়েছে। যেখানে একটি সাধারণ সিটির শব্দদূষণের মাত্রা ৫০ ডেসিবেল হওয়া উচিত, সেই জায়গায় আমাদের ঢাকার শব্দদূষণের মাত্রা দ্বিগুণেরও বেশি, অর্থাত্ ১১৯ ডেসিবেল। চিন্তা করা যায় আমাদের এই ঢাকায় ২ কোটিরও বেশি জনবসতি রয়েছে। মানবস্বাস্হে্যর কথা চিন্তা করলে গা শিউড়ে ওঠে।
শব্দদূষণের কারণে হূদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, মাথাব্যথা, খিটখিটে মেজাজ, পেপটিক আলসার, অস্হিরতা, উত্কণ্ঠা, অমনোযোগী ভাব, ঘুমে ব্যাঘাত, শ্রবণশক্তি, স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, এমনকি মেয়েদের পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অপর দিকে ঢাকা মহানগরীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোর পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে শব্দদূষণ। উচ্চ শব্দদূষণের কারণে প্রাণিকুল আজ বিলুপ্তির পথে, শহর আজ পাখিশূন্য। রাজধানী ঢাকার সৃষ্ট শব্দদূষণে প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে হাজার হাজার শিশুর শ্রবণ ক্ষমতা ধ্বংস হচ্ছে।
যানবাহন, যানবাহনের হর্ন, মাইক, লাউড স্পিকার, ইট ও পাথর ভাঙার মেশিন, জেনারেটর ইত্যাদি থেকে নির্গত শব্দ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্হে্যর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই সময় এসেছে এই শব্দদূষণের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করা। যদিও বিষয়টি মোটেও সহজসাধ্য নয়। তাই দেরি না করে জনসচেতনতার মাধ্যমে এবং আইন প্রয়োগ করে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
শব্দদূষণের বিশেষ শিকার হচ্ছেন রাস্তায় যারা কাজ করেন বিশেষত ট্রাফিক পুলিশ ভাইয়েরা, রাস্তায় জ্যামে আটকা পড়লে যখন চিকিত্সক পরিচয় পাই, ‘স্যার আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথা করে, রাতে ঘুম আসে না, বাসায় গিয়ে বিনা কারণে বৌ-বাচ্চাদের সঙ্গে খিটখিটে মেজাজ করি। হাসপাতালে আসব, আমাকে একটু চিকিত্সা করবেন।’
ঢাকা হচ্ছে বিশ্বের একটি অন্যতম জনবহুল ও অপরিকল্পিত মহানগর। রাস্তায় অযথা গাড়ির হর্ন বাজিয়ে, মাইক ও লাউড স্পিকার দিয়ে পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে শব্দদূষণ করে না। উন্নত দেশগুলোতে দেখেছি হাজার লোকের সমাবেশে উচ্চ শব্দের মাইক ব্যবহার না করে মাউথ স্পিকারের মাধ্যমে বক্তৃতা দেওয়া হয়। মিছিলে উচ্চকণ্ঠে স্লোগান দিয়ে শব্দদূষণ না করে প্ল্যাকার্ড বহন করা হয়। বাস স্টেশনগুলো এমনভাবে তৈরি, আশপাশে শব্দদূষণের কোনো প্রভাব পড়ে না। যেমন : মালয়েশিয়ার পুডু সেন্ট্রাল বাস স্টেশনে গিয়ে বোঝার উপায় নেই, সেটি একটি বাস স্টেশন। একটি শপিংমল মাত্র। রেল স্টেশনগুলো এমনভাবে তৈরি, ইঞ্জিনের হর্ন ও শব্দ আবাসিক এলাকায় কোনো প্রভাব ফেলে না। পোল্যান্ডের ওয়ারশতে দেখেছি আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ ট্রেনগুলো রাজধানীতে ঢুকেই মাটির নিচ দিয়ে স্টেশনে চলে যায়। ঢাকা সিটিতে ট্রেন এসেই হর্ন দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। আশপাশের লোকজনের যে ক্ষতি হচ্ছে সেই তোয়াক্কাই করে না।
আর আমাদের দেশে হাসপাতালে যখন রোগী দেখছি, রাস্তায় মাইক দিয়ে কেউ বক্তৃতা দিচ্ছে, ওষুধ বিক্রি করছে, মাইক দিয়ে গান বাজিয়ে কেউ লটারির টিকিট বিক্রি করছে, কারণে-অকারণে বাস-ট্রাক-ড্রাইভাররা হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে বাইর থেকে হাসপাতালের ভেতরেও শব্দদূষণ করছে। শাহ্বাগ বিএসএমএমইউর লাইব্রেরিতে পড়তে গেলে বোঝা যায়, শব্দদূষণ কী মারাত্মক। দেশের দুটি শীর্ষ চিকিত্সা প্রতিষ্ঠান এই শাহবাগে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, অন্তত এই শাহ্বাগকে প্রাথমিকভাবে শব্দদূষণমুক্ত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করার নির্দেশ দিন।
গাজীপুরে পিকনিকে মাইক বাজানোর সময় পাশের স্পটে আগত বিদেশিরা অভিযোগ করে বলল, তোমরা কেন মাইক দিয়ে শব্দদূষণ করে বনাঞ্চলকে পশুপাখিশূন্য করছ। এজন্যই তো তোমাদের দেশে পশুপাখি আজ বিলুপ্তির পথে, মাইক না বাজিয়েও তো আনন্দ করা যায়। তাই বিনোদনের সময়ও শব্দদূষণ ঘটছে।
বাড়িতে, অফিসে, রাস্তাঘাটে, বিপণি কেন্দ্রে, রেল, বাস স্টেশনের মাধ্যমেও শব্দদূষণ হচ্ছে। শব্দদূষণ সম্পর্কে এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বিএএফ শাহীন কলেজের কাছে শব্দদূষণ দিনের বেলায় ৭৪ ডেসিবেল এবং রাতের বেলায় ৮৩ ডেসিবেল। মতিঝিল সরকারি হাই স্কুলের কাছে দিনে ৭৯ ডেসিবেল এবং রাতে ৮৫ ডেসিবেল, ধানমন্ডি সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের সামনে দিনের বেলায় ৭৫ ডেসিবেল, বিএসএমএমইউ হাসপাতালের কাছে দিনে ৭৫ ডেসিবেল এবং রাতে ৮৩ ডেসিবেল। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্হার মতে, নগর পরিবেশের জন্য নিরাপদ শব্দ মাত্রা হচ্ছে ৪৫ ডেসিবেল।
পূর্বেই উল্লেখ কমরছি, শব্দদূষণের কারণে হূদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, মাথা ব্যথা, খিটফিটে মেজাজ, পেপটিক আলসার, উত্কণ্ঠা, অমনোযোগী ভাব, ঘুমের ব্যাঘাত, শ্রবণশক্তি এবং স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।
বিভিন্ন মাত্রার শব্দ ভিন্ন ভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। যেমন :
৩০-৩৫ ডেসিবেলের ওপর শব্দমাত্রায় : নার্ভাসনেস ও ঘুমের ব্যাঘাত;
৬৫ ডেসিবেলের ওপর শব্দমাত্রায় : হূদরোগ;
৯০ ডেসিবেলের ওপর শব্দমাত্রায় : আলসার, শ্রবণে ব্যাঘাত ও স্নায়ুতন্ত্রের পরিবর্তন;
১২০ ডেসিবেলের ওপর শব্দমাত্রায় : শ্রবণযন্ত্রে ব্যথা এবং স্হায়ীভাবে শ্রবণশক্তি লোপ পেতে পারে।
এছাড়া শব্দদূষণের ফলে শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের সমস্যাই দেখা দেয় এবং এটা হতে পারে স্হায়ী বা অস্হায়ী। হঠাত্ কোনো উচ্চশব্দে কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে এবং সঙ্গে রক্তক্ষরণও হতে পারে। উচ্চ শব্দে কানের মধ্যে ইনফ্লামেশন হয়ে ইফিউশন হতে পারে।
উচ্চ শব্দের উত্সের কাছে দীর্ঘদিন কাজ করলে একজন মানুষের শ্রবণক্ষমতা স্হায়ীভাবে বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। রোগী, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জন্য শব্দদূষণ মারাত্মক ক্ষতির কারণ। শব্দদূষণের কারণে বিকলাঙ্গ শিশুও জন্মগ্রহণ করতে পারে।
প্রচণ্ড শব্দদূষণ শিশুদের মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনছে। কোনো শিশুর কানে যদি খুব কাছ থেকে উচ্চ শব্দ আসে, তাহলে তার শ্রবণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। শব্দদূষণের কারণে প্রতি দিন হাজার হাজার শিশুর শ্রবণক্ষমতা ধ্বংস হচ্ছে। এর প্রতিকার জরুরি। হ লেখক : স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা