শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শ্রীলঙ্কার মানবিক বিপর্যয় পরিস্থিতি ও আমরা

আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২২, ০৬:৪৫

বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই শ্রীলঙ্কায় খাদ্য ও জ্বালানির সংকট চরমে উঠেছে। দেশটিতে কাগজেরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। কাগজের সংকটের কারণে সম্পতি প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নিউজপ্রিন্টের সংকটে কিছু কিছু কাগজের পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। ভালো মানের এক কেজি চাল কিনতে সেখানে প্রায় ৫০০ থেকে ৫৫০ রুপির মতো লাগছে। নিম্নমানের চাল কিনতেও ২০০ রুপির মতো লাগছে (শ্রীলঙ্কান ১ রুপি=বাংলাদেশি ৩০ পয়সা)। জ্বালানির সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ ও পরিবহনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। কার্যত দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কখনো এতটা দুরবস্থায় পড়েনি দেশটি।

অথচ জানলে অবাক হবেন, ২০১৬ সালের জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন রিপোর্ট অনুসারে শ্রীলঙ্কার শিক্ষার হার ছিল ৯২.৬%; যা ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের শিক্ষার হার থেকে অনেক ওপরে। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে গণমুখী। তাদের স্বাস্হ্যব্যবস্থাও দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। পর্যটকদের কাছেও একসময় আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছিল দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা।

কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে আজ শ্রীলঙ্কার এই পরিণতি কেন? এক কথায় বলতে গেলে বলতে হবে, ভ্রান্ত ও স্বেচ্ছাচারি নীতিই শ্রীলঙ্কাকে আজ পথে বসিয়েছে। শ্রীলঙ্কার জনগণ ক্ষমতাসীন সরকারের যে ভ্রান্ত ও স্বেচ্ছাচারী নীতির কারণে ভুগছে, তা শুধু একটি রাষ্ট্রের জন্যই নয়; ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ সবার জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। ২০১৯ সালে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসা দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের সরকার তখন স্থিতিশীলতা ও দৃঢ়ভাবে দেশ পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সমালোচকেরা এই সরকারের বিরুদ্ধে এখন ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করছেন। কারণ প্রেসিডেন্টের আপন ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও ভাতিজারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। যদিও এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ছাড়া মন্ত্রিসভার ২৬ সদস্য গত ৩ এপ্রিল রাতে এক বৈঠকের পর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। আদতে দেশটি যেন এক ব্যক্তিগত পারিবারিক দেউলিয়া কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।

দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে যদিও বলা হচ্ছে, করোনা মহামারির কারণে পর্যটন খাত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। অবশ্য করোনা মহামারির আগে থেকেই ২০১৯ সালে চার্চগুলোতে সিরিজ হামলার ঘটনাও পর্যটন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। করোনা সেই আগুনে তুষ ছিটিয়েছে। আজকে শ্রীলঙ্কার এই পরিণতি হওয়ার পেছনে পর্যটন খাতে ধস একটি কারণ। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অদক্ষতা ও অদূরদর্শীতাই ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেছে। দক্ষতা ও দূরদর্শিতা দেখাতে পারলে পর্যটন খাতের ধস সমগ্র অর্থনীতিতে কোনোভাবেই এতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারত না।

অবশ্য নানা সূত্র বিশ্লেষণে যা জানা যাচ্ছে তা হলো, আগের সরকারগুলোর আমল থেকেই শ্রীলঙ্কা অনেকটা ভ্রান্ত নীতিতে এগোচ্ছে। বর্তমান সরকারের ভ্রান্িতবিলাশ পতনকে আরো বেশি ত্বরান্বিত করেছে। গত ১৫ বছর ধরে শ্রীলঙ্কায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ তেমন একটা আসেনি। বিদেশি বিনিয়োগের পরিবর্তে বিভিন্ন সরকার ঋণ করার প্রতি মনোযোগী হয় এবং গত ১৫ বছরে শ্রীলঙ্কা বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তাঘাট এবং আরো নানা ধরনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। দেশের মানুষকে আলীক স্বপ্ন দেখানো হয়েছে—হংকং, দুবাই এবং সিঙ্গাপুরকে টেক্কা দেবে শ্রীলঙ্কার অবকাঠামো উন্নয়ন। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রধান অংশীদার চীনসহ বিভিন্ন উত্স থেকে শ্রীলঙ্কা ঋণ নিয়েছে। বিপুল অর্থ খরচ করা হলেও অনেক প্রকল্পঅর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়নি।

২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর জনগণের সস্তা বাহবা কুড়ানোর জন্য শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট দেশটিতে ভ্যাট ও ট্যাক্স কমানোর মতো দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেয়। ভ্যাট প্রদানের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশে আনা সহয়। সরকারের রাজস্ব আয় কমানোর এমন আকস্মিক পদক্ষেপে সে সময় সে দেশের অর্থনীতিবিদেরাও বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করার জন্য ভ্যাট-ট্যাক্স কমানোর চেষ্টা করা হলেও ফলাফল উলটো হয়ে রাজকোষ শূন্য হয়েছে। ২০১৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে কোনপ্রকার পূর্বপ্রস্ত্ততি ছাড়াই হঠাত্ করে দেশে অর্গানিক কৃষি চালু করেন। সে জন্য কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করে শ্রীলঙ্কায় সার আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে খাদ্য উত্পাদনে। এতে চালের উত্পাদন ব্যাপক হারে কমে যায়। একসময় চাল উত্পাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্রীলঙ্কা বাধ্য হয় বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করতে। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যাপক টান পড়ে। বিশ্বের অন্যতম চা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা দেশ শ্রীলঙ্কায় অর্গানিক কৃষির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশটির চা উৎপাদনেও। এ ক্ষেত্রেও রপ্তানি আয় বন্ধ হয়ে যায়।

অদূরদর্শী নীতি এবং শাসনতান্ত্রিক দুর্নীতি যখন শ্রীলঙ্কাকে এই পর্যায়ে নামিয়েছে, তখন অনেকে বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিতে বলছেন। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশকে মেলানোর কোনো সুযোগই নেই। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পরিকল্পিত ও কার্যকর অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে হ্যাঁ, অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশেও প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক দুর্নীতি আছে। এসব দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে বাংলাদেশকে ঠেকানোর সাধ্য কার? অন্যদিকে একটি দেশের শক্তিশালী রাজস্ব আয় উন্নয়ন আগ্রগতির অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের রাজস্ব আয় দিনদিন আধুনিক ও স্মার্ট হচ্ছে। সরকার কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া হঠাত্ করে ট্যাক্স কমানোর মতো দুসাহস এখন পর্যন্ত দেখায়নি। বরং জনগণ ক্ষুব্ধ হলেও অনেক ক্ষেত্রে আরো বাড়িয়েছে। সত্তরের দশকে দেশে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হতো, এখন তার চেয়ে কয়েক শ গুণ বেশি রাজস্ব আদায় হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আর এক চালিকাশক্তি প্রবাসী আয়ের আকাশচুম্বি উলম্ফন। তবে যেকোনো মূল্যে ৮৫ শতাংশ গার্মেন্টসনির্ভর রপ্তানি আয় থেকে বেরিয়ে রপ্তানি বহুমুখীকরণে জোর দেওয়া এখন সময়ের দাবি। অর্থনৈতিক গতিময়তার কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন প্রায় সারা বছরই সমৃদ্ধ থাকে এবং সেই রিজার্ভ দিয়ে কমপক্ষে ৬ থেকে ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মিটানোর সক্ষমতা থাকে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ এখন ঋণ করে নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে নিজস্ব অর্থায়নে মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের স্বক্ষমতাও অর্জন করেছে। পদ্মা সেতু তার একটি প্রকৃষ্ট উদহারণ। তবে এখনো বাংলাদেশের ঋণনির্ভরতা আছে, সেটিও আস্বীকার করা যাবে না। দেশ যেভাবে চলছে, তাতে অনিয়ম দূর করে ঋণনির্ভরতা কমাতে পারলে সত্যিই বাংলাদেশকে ঠেকানোর সাধ্য কারো নেই।

বাংলাদেশের মানুষকে বলব, একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো। আপনারা কতটা সুখে আছেন কল্পনাও করতে পারছেন না। এখন দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা সবাইকে টপকে সবচেয়ে বেশি সুখে আছে বাংলাদেশের মানুষ। ওসব দেশের এখনকার পরিসংখ্যান দেখলে স্পষ্ট বুঝতে পারবেন। একথা সত্য, এ দেশেও ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি, কালোবাজারি আছে; দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আছে। খোঁজ নিলে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়াসহ পৃথিবীর সব দেশেই এখন খাদ্যসহ পণ্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী। আবার আমরা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক মানবিক মানুষ তৈরি করতে পারছি না। অনিয়ম দূর করতে পারলে, সত্যিকারের মানবিক মানুষ তৈরি করতে পারলে বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীর অন্যতম সুখী দেশের কাতারে পৌঁছে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক: বিটিভির উপস্থাপক, তথ্যচিত্র নির্মাতা ও কলাম লেখক

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন