শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা

আপডেট : ০৮ মে ২০২২, ০৩:৩০

বাংলায় একটি প্রবাদ রহিয়াছে— ‘এলোমেলো করে দে মা লুটেপুটে খাই।’ তৃতীয় বিশ্বে যাহারা নিজেদের ইচ্ছামতো লুটিয়াপুটিয়া খাইতেছেন— তাহাদের নিকট শিখিবার অনেক কিছু রহিয়াছে। তাহারা সকল সময়ই ক্ষমতাসীন দলের। যখন যেই দল ক্ষমতায় আসে, তখন তাহারা সেই দলের পদ-পদবি নাম সাইনবোর্ড নিজের নামে ক্রয় করেন অনেক অর্থের বিনিময়ে। দলীয় কর্মীপদ নহে, তাহারা ‘ক্ষমতা’ ক্রয় করেন। কারণ, ইহার বিনিময়ে ঐ সকল লুটপাটকারী সিন্দুক ভাঙিবার শাবলের দখল পান। মজার ব্যাপার হইল, তৃতীয় বিশ্বের কোনো কোনো রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী এই সকল লুটপাটকারীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া বলিয়া থাকেন—ইহাদের উত্খাত করিতে হইবে, প্রতিহত করিতে হইবে; কিন্তু দুঃখের বিষয় হইল, বাঘের ঘরেই দেখা যায় ঘোগের বাসা। দলীয় পদ-পদবি কিনিয়া লুটপাট করিতেছে বাহিরের লোকেরা; কিন্তু বদনাম হইতেছে দলের। এই ঘোগদের যন্ত্রণায় বাঘের প্রকৃত ও ত্যাগী অনুসারীরাও অতিষ্ঠ। অন্যদিকে অতীতে যাহারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন বড় বড় কাজের সুবিধাভোগী ছিলেন, তাহাদের কাজের প্রোফাইল ভারী হইবার সুযোগ তাহারা পরবর্তী সময়েও লইয়া থাকেন। এই মনোপলি অবস্থা ভাঙিতে যে নূতন করিয়া নিয়ম তৈরি করা প্রয়োজন— তাহা ক্ষমতাসীনরা অনেক ক্ষেত্রেই বুঝিতে পারেন না। নিয়মকানুনের পরিবর্তনও হয় না, নূতনরা কাজের সুযোগও পান না।

এইভাবে নানান স্তরে তৃতীয় বিশ্বের নানান ধান্ধাবাজ গোষ্ঠী তাহাদের দেশটিকে লুটপাট করিতেছেন ভয়ংকরভাবে। ব্ল্যাকহোল যেমন সকল কিছু শুষিয়া লয়, এমনকি আলোকেও রেহাই দেয় না, ইহারা ব্ল্যাকহোলের মতো সকল কিছু গ্রাস করিতে চাহে। এবং সাধ্যমতো তাহারা গ্রাস করিয়াও থাকে; কিন্তু এইভাবে কি চলিতে পারে? ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সময় মানুষ বিশ্বাস করে যে, এই পট পরিবর্তনের মাধ্যমে তাহাদের এতদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিবে; কিন্তু পট পরিবর্তনের কিছুদিন পরই মানুষ অনুধাবন করিতে পারে— রাষ্ট্রের জন্য যাহাদের প্রতিবন্ধক বলিয়া মনে করা হইত, তাহাদের সরাইতে যাহারা আসেন— তাহারা কোনো ম্যাজিক দেখাইতে পারিতেছেন না। বরং তাহারাও বাড়াবাড়ি করিতে দ্বিধা করিতেছেন না। যদিও বিশ্বজগতে বাড়াবাড়ির কোনো স্থান নাই। জগতের সকল কিছুর ভিতরেই রহিয়াছে এক আশ্চর্য ভারসাম্য। ইহাই শৃঙ্খলা, ইহাই নিয়ম, ইহাই প্রকৃতির আইন। রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিতরেও এই শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা রহিয়াছে; কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের কোনো কোনো দেশে ইহার ব্যত্যয় ঘটিতে দেখা যায়। এই অবস্থায় সেই রাষ্ট্রে নানান ধরনের বিশৃঙ্খলা ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি হইতে থাকে। ইতিহাসেই দেখা যায়, যাহারা সকল কিছু নিজের নিকট কুক্ষিগত করিতে চাহেন, তাহাদের অবস্থা শেষাবধি পরিহাসে পরিণত হয়। দশকের পর দশক ধরিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যাহারা ক্ষমতার ছিলেন, ইহাও সত্য যে, একটি সময় পর্যন্ত সকল কিছুই তাহাদের কুক্ষিগত ছিল। এককভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কয়েক দশক ধরিয়া তাহারা ক্ষমতায় থাকিয়া সাময়িকভাবে লাভবানও হইয়াছিলেন বটে; কিন্তু পতনের পর তাহাদের পরিণতি হয় তাসের ঘরের মতো। সুতরাং সকল কিছু কুক্ষিগত করিবার সুদূরপ্রসারী এই প্রতিক্রিয়া উপেক্ষণীয় নহে। এই উদাহরণের শেষ নাই। নিকট প্রতিবেশীর ঘরেও এই উদাহরণ রহিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বত্সরের বাম-জামানার সেইখানে বিন্দু হইতে সিন্ধু অবধি সকল কিছুর মধ্যে কেবল কাস্তে-হাতুড়ি ও লাল রং দেখা যাইত। লক্ষ লক্ষ পিপীলিকার স্রোতের মতো চারিদিকে ছিল কেবল তাহাদেরই কর্মী; কিন্তু যখন তাহাদের পতন ঘটিল, তাহার কয়েক বত্সর পর দেখা গেল, পতনের এপিটাফে প্রদীপ দেওয়ার মতো সামান্য কর্মীও নাই। কোথায় গেল সেই লক্ষ লক্ষ কর্মীর বাঁধভাঙা স্রোত?

দুঃখজনকভাবে পট পরিবর্তনের পর পূর্বসূরিদের এমন সকল অপরাধ দুর্নীতি-অপকর্মের ফিরিস্তি বাহির হয়, যাহা ক্ষমতায় থাকিবার সময় তাহারা কল্পনাও করিতে পারেন না। সুতরাং স্পষ্ট করিয়া বলিলে, তৃতীয় বিশ্বের কোনো কোনো জনপদের মানুষ গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করিতেছে। তাহারা যেন একটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে বসিয়া আছে। উহার উত্তাপ ও হঠাৎ প্রকাশিত মৃদুমন্দ ধোঁয়াও দেখা যাইতেছে।

ইত্তেফাক/এসজেড