শ্রীলঙ্কার সরকার করোনা ভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে ধস নামিয়া আসিয়াছে বলিয়া একাধিকবার বিবৃতি দিয়াছে| শুধু শ্রীলঙ্কা নহে, প্রথমে করোনা ভাইরাস এবং পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের কারণে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিতেই নামিয়া আসিয়াছে দুর্বিপাক| অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলি পরিস্থিতি খানিকটা সামাল দিতে পারিলেও উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ দেশ হিমশিম খাইতেছে| তাহা ছাড়া বড় তথা উন্নত দেশগুলিকেও বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার ইনজেক্ট করিয়া টিকিয়া থাকিতে হইতেছে| আশঙ্কার বিষয় হইল, পরিস্থিতি শীঘ্রই ঘুরিয়া দাঁড়াইবে—এমন সম্ভাবনা আপাতত দৃশ্যমান নহে| ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়াইয়া পড়িলে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হইয়া যায়| বিশ্বনেতারা প্রাথমিক ভাবে ধারণা করিয়াছিলেন উন্নত বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৯ শতাংশ কমিয়া আসিবে; কিন্তু বৎসর ঘুরিয়া আসিতে দেখা গিয়াছে তাহা ৪ দশমিক ৫ শতাংশ নামিয়া গিয়াছে|
অন্যদিকে দরিদ্র দেশগুলির নুন আনিতে পান্তা ফুরায় অবস্থা তৈরি হইয়াছে| এই পরিস্থিতি সামাল দিতে যখন বিশ্বনেতারা প্রস্ত্ততি লইতেছিলেন, তখনই রাশিয়া ইউক্রেনের উপর হামলা করিয়া বসে| বাস্তবে এই যুদ্ধের সহিত পরোক্ষভাবে যে বহু দেশ জড়াইয়া পড়িয়াছে তাহাই নহে, বিশ্বের সকল দেশেই এই যুদ্ধের তাপ উপলব্ধি করিতেছে| রাশিয়া এবং ইউক্রেন দুইটি দেশ মিলিয়া বিশ্বের ৩০ শতাংশ গম রপ্তানি করিয়া থাকে| স্বাভাবিক কারণেই এই সরবরাহ বন্ধ হইবার ফলে বিশ্বের খাদ্যশস্যের উপর চাপ পড়িয়াছে| আর সেই চাপ কতটা কঠিন তাহা অনুমেয়| অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি সচল রাখিতে জ্বালানি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান| রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপসহ বহু এলাকায় জ্বালানির সংকট দেখা দিয়াছে, যাহা চরমভাবে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যাহত করিতেছে| বিশ্বব্যাংক তাহাদের সর্বশেষ স্টেটমেন্টে বলিয়াছে, ইতিমধ্যে জাতিসংঘের যে নির্ধারিত দারিদ্র্যসীমা তাহার নিচে নামিয়া আসিয়াছে বিশ্বের আরো ৩০ শতাংশ মানুষ| আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ সতর্ক করিয়া বলিয়াছে, সাব-সাহারান আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, ককেশীয় অঞ্চল এবং মধ্য এশিয়ায় খাদ্যনিরাপত্তা যে ঝুঁকির মধ্যে পড়িয়াছে তাহা রাজনৈতিক অস্থিরতা ডাকিয়া আনিতে পারে| যেই সকল দেশে সামাজিক সুরক্ষা দুর্বল সেই সকল দেশে জনগণ সরকার পরিবর্তনের জন্য অস্থির হইয়া উঠিবে|
শ্রীলঙ্কায় যাহারা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামিয়াছেন তাহারা কোনো ব্যক্তির দিকে তাকান নাই| তাহাদের সবচাইতে বড় বক্তব্য হইল, সরকার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হইয়াছে| সুতরাং বর্তমান এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলির যেই সকল দেশের অর্থনীতি নাজুক, সেই সকল দেশকে ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে অতি সতর্ক হইতে হইবে| মনে রাখিতে হইবে বিশ্বের কোন দেশের জন্যই ইহা কোনো স্বাভাবিক সময় নহে| আয়ের সহিত ব্যয়ের হিসাব কষিতে হইবে, দুর্নীতির সুযোগ যতটা সম্ভব রোধ করিতে হইবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিস্টেম লসের ভূত তাড়াইতে হইবে| ইহাই ব্যবস্থাপনা হিসাবে এই দুর্বিষহ সময়ে কিছুটা হইলেও ব্যথায় উপশম দিবে| মনে রাখিতে হইবে, যাহারা এখনো উত্তাপ প্রচণ্ডভাবে অনুভব করে নাই, তাহাদের জন্যও সামনের দিনগুলি অনিশ্চয়তা লইয়াই আসিতেছে|