বিশ্বব্যাপী নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলি ত্রিমুখী সংকটের সঙ্গে লড়াই করিতেছে। এই ত্রিমুখী লড়াই হইল—মহামারি, তাদের ঋণের ক্রমবর্ধমান ব্যয় এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যত্বৃদ্ধি। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট কিছুদিন পূর্বে বলিয়াছেন যে তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলি লইয়া গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তাহারা জ্বালানি, সার ও খাদ্যে আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধির সম্মুখীন হইতেছে। এই সমস্যাগুলি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে কঠোরভাবে আঘাত করিতেছে। খাদ্য, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং আর্থিক দুরবস্থা—এই তিনটি ধাক্কার মুখোমুখি হইয়াছে বিশ্বের ৬৯টি দেশ। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলির তালিকাও দীর্ঘ। আইএমএফ মিশর ও তিউনিসিয়ার সঙ্গে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের আলোচনা শুরু করিয়াছে। উভয় দেশই রাশিয়া ও ইউক্রেন হইতে বিপুল গম আমদানি করিয়া থাকে। সাব-সাহারান আফ্রিকান দেশগুলির মধ্যে ঘানা, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইথিওপিয়া অধিক বিপদে রহিয়াছে। আর্জেন্টিনাসহ লাতিন আমেরিকান দেশের মধ্যে ঝুঁকিতে রহিয়াছে এল সালভাদর ও পেরু। কয়েক মাস ধরে অনুমান করা হইতেছিল তুরস্কের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হইবে। দেশটির বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ৭০ শতাংশ। তাহা সত্ত্বেও দেশটি এখনো টিকিয়া রহিয়াছে এবং নিজের জনগণকে খাওয়াইতে সক্ষম হইতেছে।
পৃথিবীর যেই সকল জায়গায় এখন যুদ্ধের অস্থিরতা চলিতেছে, যুদ্ধ এবং উহার অভিঘাত কেবল সেইখানে আটকাইয়া নাই। আমরা দেখিতে পারিতেছি সারা বিশ্ব কী রকম অস্থির উত্তপ্ত হইয়া উঠিতেছে। কেন এই রকম যুদ্ধ হইবে? কেন মারা পড়িবে বেসামরিক মানুষ ও নারী-শিশুরা? কী তাহাদের অপরাধ? কেন অবোধ শিশুদের সহ্য করিতে হইবে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, মৃত্যুর হাহাকার? কেন নির্মমভাবে নষ্ট হইবে তাহাদের শৈশব? এত এত বাড়াবাড়ি? বাড়াবাড়ি ভালো নহে—বহুল উচ্চারিত এই কথাটি আমরা প্রায়শই শুনিয়া থাকি। কিন্তু ইহা অসংখ্যবার শুনিবার পরও কেন তাহাকে গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করি না আমরা? আমরা বিশ্ব জুড়িয়া এখন যেই যুদ্ধবিগ্রহ ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেখিতেছি, তাহা অনেকটাই কিছু শীর্ষ মানুষের বাড়াবাড়ির বিষফল। মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টি করিয়াছেন জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা, আত্মমর্যাদাবোধ দিয়া। আর তাহার পর সতর্ক করিয়াছেন বাড়াবাড়ি না করিতে। অথচ এত কিছুর পরেও আমরা বাড়াবাড়ি করিতে ভয় পাই না। ইহাই বড় ট্র্যাজেডি।
প্রকৃতপক্ষে যাহারা যথার্থ জ্ঞানী, তাহারা নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি করিতে ভয় পান। অন্যদিকে যাহারা অপরিণামদর্শী, তাহারাই কেবল সীমা লঙ্ঘনের বিপদ অনুধাবন করিতে ব্যর্থ হন। ইহা সকল ক্ষমতাধারীকে বুঝিতে হইবে। নচেৎ সমাজ-রাষ্ট্রের শৃঙ্খলার ভারসাম্য বিঘ্নিত হইবে বারবার। আর ইহার জন্য অনেক বেশি মূল্য চুকাইতে হইবে সংশ্লিষ্ট সমাজ-রাষ্ট্রকে। সক্রেটিস বলিয়াছেন—“অতএব সে-ই ব্যক্তি জ্ঞানী যিনি তাহার অজ্ঞতার ‘রকম ও পরিমাণ’ জানেন।” এই কথার সমীকরণ ধরিয়া আমরা এইরকম মীমাংসার রেখা টানিতে পারি যে, নিজেকে জ্ঞানে ঋদ্ধ করিতে হইলে নিজের ‘অজ্ঞতা’কে সবার আগে জানিতে হইবে। কিন্তু যাহারা নিজেকে জানেন না, তাহারা নিজের অজ্ঞতাও জানেন না। সুতরাং আমরা পুনর্বার উচ্চারণ করিতে চাই সেই বিখ্যাত উক্তি—‘নো দাইসেল্ফ’—নিজেকে জানো। আমরা যদি আমাদের সীমাবদ্ধতা না বুঝি তাহা হইলে আমরা যাহা নই, নিজেদের তাহাই ভাবিব। ইহাই অজ্ঞতা। নিজেকে যেমন জানিতে হইবে, তেমনি ভালোবাসিতেও হইবে নিজেকে। নিজেকে নিজের ‘সময়’ দিতে হইবে। নিভৃতে ভাবিতে হইবে। তখন নিজেও বুঝিতে পারিবেন, কোথায় আপনার সীমাবদ্ধতা, কোথায় আপনি বাড়াবাড়ি করিতেছেন।