সমস্যার অন্ত নাই। প্রায় সাত যুগ সময় পার হইয়াছে। পরাধীনতার নাগপাশ হইতে মুক্তি মিলিয়াছে। ইহার পর মুক্তি মিলিবার কথা ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যের। মুক্তি মিলিতে পারিত অসহনীয় দারিদ্র্য হইতে। এই জনপদের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী সকল মানুষকে একত্রিত করিলে তাহারা পুরা ইউরোপের (প্রায় ৪৪ কোটি) মানুষের চাইতে অধিক হইবে। এই যখন অবস্হা, তখন গত সাত দশকে কোটি কোটি অসহায়-দরিদ্র মানুষের দুঃখ-কষ্ট মানবেতর জীবনের তাত্পর্যপূর্ণ উন্নয়ন ঘটিতে পারিত। সাত দশক কম সময় নহে; কিন্তু যাহা হইয়াছে, তাহাকে বলা যায় লুটেরাদের রাজত্ব। এই লম্বা সময়ে লুটেরাদের সংখ্যা বাড়িয়াছে, তাহাদের অর্থ-অহমিকা আর জৌলুস বিশ্বকে চমকাইয়া দেয়; কিন্তু এই সকল উজ্জ্বল প্রদীপের নিচে যতদূর চোখ যায়, শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার! প্রদীপের নিচে অন্ধকার তো থাকিবেই; কিন্তু তাহা যেন নিঃসীম। দুঃখজনকভাবে সেই অন্ধকার দূর করিবার জন্য সাত দশকে যেই সকল ব্যবস্হা গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল, তাহা করা হয় নাই। যেই কারণে লুটেরাদের সংখ্যা বাড়িয়াছে, তথাকথিত উজ্জ্বল প্রদীপ বাড়িয়াছে; কিন্তু অন্ধকার দূর হয় নাই। উলটা অন্ধকার আরো ঘন হইয়াছে। বিশ্বের গড় মাথাপিছু আয়ের পাঁচ ভাগের এক ভাগ মাত্র। অর্থনৈতিক বৈষম্যও নিশ্চিতভাবে বাড়িয়াছে। গত দুই বত্সরে পরিস্হিতি আরো খারাপ হইয়াছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ দারিদ্রে ডুবিয়াছে। ইহার সহিত ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক উদ্যোগ ঝাঁপ ফেলিয়াছে। এই সকল জনপদে অর্থনীতি যেই পথে চলিতেছে, তাহাতে লুটেরাদের হাতই শক্ত হইতেছে। খাদ্যসংকট, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি হইতেছে; কিন্তু মানুষের হাতে টাকা নাই। ক্রয়ক্ষমতা কমিতেছে। স্বাভাবিকভাবে মনে ক্ষোভ বাড়িতেছে মানুষের।
এই যখন অবস্হা, যাহারা রাষ্ট্রের নিয়ামক হন তাহারা অতীত লইয়া কচকচানি করেন, ইতিহাসকেও পুনর্লিখনে উদ্যোগী হন। মানুষের ক্ষোভের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরাইতেই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের জিকির তুলিতেছে। স্বাস্হ্য খাত, ধর্মীয় সহনশীলতাসহ সমস্ত ক্ষেত্রের গভীর ত্রুটিগুলি দেখা দিতেছে। আর এই সকল ত্রুটি ধামাচাপা দিতে এবং জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘুরাইতে পুরাতন ইতিহাসের তথাকথিত অসংগতি তুলিয়া ধরিতেছে দায়িত্বশীল মহল। ধর্মীয়-বিদ্বেষ ও ঘৃণামূলক বিকৃত তথ্য প্রচার করিতেছে তাহাদেরই দোসর শত শত নিউজ চ্যানেল। বলা যায়, সমাজমাধ্যম ও অন্যান্য গণমাধ্যমে পরিবেশিত ও প্রচারিত বিকৃত ও বিভ্রান্তিকর তথ্য জনমতকে ভুল পথে পরিচালিত করিতেছে। সত্যিকারের সমস্যাগুলিকে পাশ কাটাইতে যুক্তির ছদ্মবেশে মিথ্যা ঘটনার প্রচার, ইতিহাসের বিকৃতি ও পুনর্নির্মাণ, ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব, অবৈজ্ঞানিক প্রচার, কুসংস্কার বা অপসংস্কার এবং ধর্মীয় বিদ্বেষের মাধ্যমে কুরুচিকর চাঞ্চল্যকর মিথ্যা রটনা প্রচার করিবার ব্যবস্হা করা হইতেছে।
ইহা এক নিপুণ ভয়ংকর খেলা। এই খেলায় পরমতসহিষ্ণুতা নাই। ভলতেয়ার যেমন বলিয়াছিলেন, ‘আমার মত তোমার মতের সঙ্গে না মিলিলেও, তোমার মতপ্রকাশের অধিকারের জন্য আমি জীবন দিতে রাজি!’ এখন বরং উলটা হইয়াছে। মতের মিল না থাকিলে অন্যের জীবন হরণ করিতেও লুটেরা ও শক্তিশালী গোষ্ঠীর বিবেক কাঁপে না। বিতর্ক-দর্শনে ‘অ্যাড হোমিনেম’ ত্রুটি বলিয়া একটি বিষয় আছে। যাহাকে বলা হয়—তর্কের যুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিযুক্তি খাড়া না করিয়া প্রতিপক্ষকে ব্যক্তিগত বা ধর্মীয়ভাবে আক্রমণ করা হয়। আমরা বুঝিতে পারি, চারিদিকে যখন এত ক্ষত, এত সমস্যা—তখন এই দিকগুলি হইতে দৃষ্টি ঘুরাইতে ইহারা বিচিত্রি প্রোপাগান্ডা বা গিমিক তৈরি করিবেই। একমাত্র জনগণের সচেতনতায় সম্ভব এই সকল মতলবি বিষয়কে নস্যাৎ করা, রুখিয়া দেওয়া; কিন্তু কে করিবে জনসাধারণকে সচেতন? এই সকল ফাঁদ হইতে কে বা কাহারা বাঁচাইবে জনসাধারণকে? আমাদের জানা নাই।