শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভীতিটা যখন সামাজিক 

আপডেট : ১৪ মে ২০২২, ০৩:০৮

সামাজিক ভীতি একটি মানসিক সমস্যা, বর্তমানে এই সমস্যাটিকে সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার (Social Anxiety Disorder) বলে। কোনো ব্যক্তি প্রেজেন্টেশন, অপরিচিত লোক, বস, বিপরীত লিঙ্গ, সামাজিক অনুষ্ঠান, মিডিয়া বা জনসম্মুখে কথা বলতে গেলে প্রচণ্ড রকম ভয় পান এবং তিনি মনে করেন যে, তিনি এমন আচরণ করবেন যাতে অন্যরা তাকে নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করবে কিংবা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। সামাজিক পরিস্হিতিগুলোতে আসলে ব্যক্তির তীব্র উদ্বিগ্নতা কাজ করে।

ব্যক্তি সামাজিক ভীতির পরিস্হিতিগুলোকে এড়িয়ে চলে কিংবা অনেক উদ্বিগ্নতা নিয়ে মোকাবিলা করে। এই মানসিক সমস্যাকে সামাজিক ভীতি ডিসওর্ডার বলে। আমেরিকার এক গবেষণায় দেখা যায় জীবনচক্রের ৪০ শতাংশ লোক কোনো না কোনো সময়ে সামাজিক ভীতিতে ভুগে থাকেন। অন্য আরেক গবেষণায় এসেছে, ১২ শতাংশ ব্যক্তি এ সমস্যায় ভোগেন। তাই সংখ্যার দিক দিয়ে এ রোগের রোগীর সংখ্যা অনেক।

কোনো কোনো পরিস্থিতিতে সামাজিক ভীতি তৈরি হতে পারে, সেই ব্যাপারটি একটু বুঝে নেওয়া যাক। অনেকগুলো পরিস্থিতিতে সামাজিক ভীতি হলেও সাধারণত নিচের পরিস্থিতিতে সামাজিক ভীতি বেশি হয়। যদিও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সামাজিক ভীতির পরিস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। যেমন : ১. কোনো কিছু প্রেজেন্টেশন করার সময়; ২. উচ্চপদস্থ কারো সঙ্গে কথা বলা; ৩. সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে; ৪. নতুন কারো সঙ্গে কথা বলা শুরু করলে; ৫. ইন্টারভিউ দিতে গেলে; ৬. কোনো মিটিং বা জনসম্মুখে কথা বলার সময়; ৭. অন্যের সামনে কিছু খাওয়া বা পান করার সময়; ৮. অন্যের সামনে লেখার সময়; ৯. নিজের মতো কাউকে বলতে গেলে ইত্যাদি।

সামাজিক ভীতির বিবিধ প্রভাব রয়েছে। বলা যায়, সামাজিক ভীতি খুবই খারাপ একটা মানসিক সমস্যা। কারণ আক্রান্ত ব্যক্তি সারাক্ষণ প্রচণ্ড মাত্রায় উদ্বেগে ভোগেন, সামাজিক দক্ষতার পরিমাণ অনেক কম হয়, অন্যদের সঙ্গে ভালোভাবে না মেশার কারণে চাকরি পেতে অনেক সমস্যা হয়, আক্রান্ত ব্যক্তি একা হয়ে পড়েন, নিজে কোনো কাজকর্ম করতে গেলে মানুষ কী ভাববে—এটা ভেবে অস্থির হয়ে থাকেন। বেশির ভাগ সামাজিক ভীতিতে আক্রান্ত ব্যক্তি বেকার থাকেন। অনেকেই নিদারুণ অর্থকষ্ট পেতে থাকেন। এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি ভালোভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন না। অনেকে আবার বিয়ে করতেও ভয় পান। এসব ব্যক্তি ধীরে ধীরে বিষণ্ণতায় ভুগতে পারেন, অনেকেই আত্মহত্যার চিন্তাও করেন।

তাই সামাজিক ভীতিতে আক্রান্ত মনে হলে যত দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া যায় ততই ভালো। চিকিৎসার ক্ষেত্রে বলা যায় এই সমস্যায় সাধারণত দুই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ক) মেডিসিন চিকিৎসা; খ) মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা। রোগের মাত্রা খুব বেশি হলে মেডিসিন চিকিৎসা দিয়ে ব্যক্তির সামাজিক ভীতির পরিমাণ কিছুটা কমানো হয়। পরবর্তীকালে সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা প্রদান করা হয়। তবে রোগের মাত্রা কম হলে শুধু সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা দিয়েই ব্যক্তির জীবনমানের উন্নতি ঘটানো সম্ভব। তবে বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে দুটি চিকিৎসাপদ্ধতি একত্রে ভালো কাজ করে।

ক) মেডিসিন চিকিৎসা: এই চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বা মনোচিকিত্সক (সাইকিয়াট্রিস্ট) কতগুলো মেডিসিন প্রেসক্রাইব করেন। রোগীকে মেডিসিনগুলো চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে খেতে হয়।

খ) মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা: সামাজিক ব্যাধি নিরাময়ে মনোবৈজ্ঞানিক চিকিত্সাগুলোর মধ্যে Cognitive Behaviour Therapy সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে ব্যক্তির ভুল চিন্তাগুলোকে খুঁজে বের করে সেগুলোর পরিবর্তে সঠিক চিন্তা করতে সহায়তা করা। ভুল চিন্তার কারণে ব্যক্তি যে আচরণগুলো করতে বাধ্য হতো সেগুলোর পরিবর্তিত আচরণ করতে শেখানো হয়। পাশাপাশি ব্যক্তির ভয়ের পরিস্হিতিগুলোর সঙ্গে এক্সপোজার করানো হয়। সামাজিক দক্ষতার প্রশিক্ষণ (Social Skill Training)-এর মাধ্যমে সামাজিক পরিবেশে মানিয়ে চলার দক্ষতার ঘাটতি মোকাবিলা করতে শেখানো হয়। কয়েকটি সেশন নিলে ব্যক্তির অনেক উন্নতি হয়। সামাজিক ভীতি রোগ একটা চিকিত্সাযোগ্য মানসিক সমস্যা। যত দ্রুত চিকিত্সা নিতে পারবেন ততই ব্যক্তি দ্রুত সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন। তাই কোনো ব্যক্তির সামাজিক ভীতি থাকলে দ্রুতই বিশেষজ্ঞ মনোচিকিত্সক কিংবা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নিন।

লেখক: ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট।

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন