বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

আপডেট : ১৪ মে ২০২২, ০৯:১২

মূল্যস্ফীতির ভূত তাড়া করিতেছে সমগ্র বিশ্বকে। সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখিয়াছে, গত তিন দশকে আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগ বাড়িবার সুবিধা পাইয়া আসিতেছিল বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি এবং তাহাদের ভোক্তাগোষ্ঠী। মুক্ত বাণিজ্যের যুগে বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক উৎপাদন ও সুলভ প্রবাহ এই সকল পণ্যের মূল্য কমাইয়া রাখিবার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করিয়াছে।

কিন্তু করোনা মহামারির দুই বৎসরের ধাক্কা আর তাহার পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের উত্তাপ ছড়াইয়া পড়িয়াছে সর্বত্র। নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণে স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে, পণ্য কোথায় উৎপাদন করা হইবে এবং মজুত করিয়া রাখিতে হইবে কি না—তাহা লইয়াও নূতন করিয়া ভাবিতে হইতেছে কোম্পানিগুলিকে। আর এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হইলে মূল্যস্ফীতি ও বিশ্বের সার্বিক অর্থনীতির উপর গুরুতর প্রভাব ফেলিবে। এমনকি পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় সাম্প্রতিক বিঘ্ন এবং ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে বৈশ্বিক উৎপাদন ব্যবস্থার চাকা উলটা পথে ঘুরিতে শুরু করিবে কি না—তাহা লইয়াও নূতন বিতর্ক দেখা দিয়াছে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে। 

এই দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান জেরোমি পাওয়েল কিছুদিন পূর্বে বলিয়াছেন—আমরা একটি ভিন্ন ধরনের বিশ্বের মুখোমুখি হইতে যাইতেছি। এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির হার ৪০ বৎসরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূলত জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৫ শতাংশে উঠিয়াছে। অন্যদিকে ব্রিটেনে মার্চে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ শতাংশের বেশি—যাহা ১৯৯২ সালের পর সর্বোচ্চ। ব্যয় কমাইতে গত বুধবার যুক্তরাজ্যে সিভিল সার্ভিসের ৯১ হাজার জনকে চাকুরী হইতে ছাঁটাই করিবার নির্দেশ দিয়াছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।

সুতরাং কোনো সন্দেহ নাই যে, সারা পৃথিবীতেই অর্থনীতির ভিতরে নীরব রক্তক্ষরণ ঘটিতেছে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে অর্থনৈতিক এই বৈশ্বিক সংকটের ভিতরেও রাঘববোয়াল, দুর্নীতিবাজ এবং লুটেরারা লুটপাট অব্যাহত রাখিতেছে। এই লুটেরা শ্রেণির নিকট তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির প্রধান ব্যক্তিও বহুক্ষেত্রেই অসহায় হইয়া পড়েন। করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের বিভিন্ন সংকট সামলাইতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করিতেছে। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বের কিছু কিছু পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য বাজারে কৃত্রিম সংকটও তৈরি করা হয়। 

বিশেষ করিয়া ভোজ্য তেলের মতো কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে ইহা করা হয়, যাহার ৯২ শতাংশই আমদানিনির্ভর। আমরা দেখিয়াছি, রমজানের শুরু হইতেই অস্থির ছিল সয়াবিন তেলের বাজার। ঈদের পূর্বে ও পরে সেই সংকট প্রবল হইয়া উঠে। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করিয়া সয়াবিন তেলের নূতন মূল্য নির্ধারণ করিবার পরও বাজার স্বাভাবিক হয় নাই। দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের হঠাৎ এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং সংকটের নেপথ্যে অনেকগুলি কারণ কাজ করিয়াছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ভোজ্য তেল হিসেবে সয়াবিনের পাশাপাশি ব্যবহৃত হয় সূর্যমুখী তেল। 

আবার বিশ্ববাজারে এই তেলের এক-তৃতীয়াংশ জোগান দিয়া থাকে রাশিয়া ও ইউক্রেন। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি মাস হইতে এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের কারণে সরবরাহ বন্ধ হইয়া যায়। সূর্যমুখী তেল সংকটের প্রভাব পড়ে সয়াবিন ও পাম অয়েলের উপর। এইদিকে সম্প্রতি খরার কারণে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলিতে সয়াবিনের উৎপাদন অনেকটা কমিয়া আসে। সব মিলাইয়া সয়াবিন তেল বিশ্ববাজারে অস্থির হইয়া উঠে। আর সেই অস্থিরতা তথা ঘোলাপানিতে মাছ শিকারে নামিয়া পড়ে তৃতীয় বিশ্বের কিছু লুটেরা। তৃতীয় বিশ্বের জন্য ইহা বড় ট্র্যাজেডি।

সার্বিকভাবে লুটেরাদের শায়েস্তা করিতে লাল ঘোড়া ছুটাইয়া অতীতে সামলানো যায় নাই। এই সকল লুটেরা ও দুর্নীতিবাজরা এমন আত্মবিশ্বাসে টগবগ করিয়া থাকেন যে, ক্ষমতাশালী সরকার যাহাই চাউক না কেন—শুদ্ধিতার কড়া অ্যাসিডও লুটেরাদের গলাইতে পারিবে না? হঠাৎ কখনো-সখনো লুটেরা শ্রেণি বিপদে পড়েন বটে। কিন্তু বিপদ কাটিয়া গেলে তাহাদের অবস্থা হয় উপকথায় কথিত কাকের মতো। কাক যেমন গাব খাইতে খুব পছন্দ করে, কিন্তু গলায় আটকাইয়া গেলে জপ তুলে—‘আর গাব খাব না/গাবতলা দিয়ে যাব না।’ কিন্তু গলা হইতে গাবের আঁটি নামিয়া যাইতেই কাক পুনরায় রব তুলে—‘গাব খাব না, খাব কী?/গাবের তুল্য আছে কী?’ লুটেরাদের গলায় গাবের আঁটি স্থায়ীভাবে আটকাইয়া না থাকিলে, তৃতীয় বিশ্বের অবস্থা হইবে—মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

ইত্তেফাক/এএইচপি