শুক্রবার, ০২ জুন ২০২৩, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বৌদ্ধসমাজে বৈশাখী পূর্ণিমার গুরুত্ব

আপডেট : ১৫ মে ২০২২, ০৬:৪৭

আজ শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা, ২৫৬৬ বুদ্ধাব্দ। তাই সবাইকে শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা জানাই। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন সরকারি ছুটি রয়েছে। এজন্য সদাশয় সরকারকে অশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। মহাকারণিক ভগবান তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ তার এই ধর্মের সর্বোত্তম বাণী হলো:

‘সব্ব পাপস্সা অকরণং কুসালস্স উপসম্পদা
সচিত্তা পরিয়োদপনং এতং বুদ্ধানসাসনং’ (ধম্মপদ : ১৮৩)।

অর্থাৎ, সকল প্রকার পাপকর্ম না করা, কুশল বা পুণ্যকর্ম সম্পাদন করা এবং নিজ নিজ চিত্ত সুন্দর বা পরিশুদ্ধ করা—এ সবই হলো বুদ্ধগণের অনুশাসন। এটাই হলো মহাকারণিক ভগবান বুদ্ধের সর্বজীবের প্রতি অহিংসার মৈত্রীভাব। এ মহান পবিত্র ‘বৈশাখী পূর্ণিমা বা বুদ্ধ পূর্ণিমা’ বৌদ্ধ বিশ্বের একটি অনন্য ধর্মোত্সবের দিন। বৈশাখী পূর্ণিমা বা বুদ্ধ পূর্ণিমা বিশ্বের বৌদ্ধসমাজে এক মহান পবিত্রতম দিন। ভগবান তথাগত বুদ্ধ তার জীবনেতিহাসের এক অবিস্মরণীয় তিনটি ঘটনাবলি তথা ত্রি-স্মৃতিবিজড়িত। জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ, এবং মহাপরিনির্বাণ প্রাপ্তি— এই তিনটি ঘটনাকেই নিয়ে বৈশাখী পূর্ণিমা। বৌদ্ধসমাজে তথা বিশ্বের প্রধান দেশে এই দিনটিকে খুবই তাত্পর্যপূর্ণ সহকারে উদ্যাপন করে আসছে। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিশ্বের প্রধান দেশে বৈশাখী পূর্ণিমাকে Vesak Day হিসেবেও অবিহিত করে।

শুভ বৈশাখী পূর্ণিমায় তত্কালীন ভারতবর্ষের কপিলাবস্ত্তর লুম্বিনী কাননে শালবৃক্ষের তলায় রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্ম। সিদ্ধার্থ ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরই সপ্তপদ হেঁটে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘জেট্ ঠোহস্মিং সেট্ ঠোহস্মিং অয়মন্তিমা জাতিং’ অর্থা‌ৎ আমিই জ্যেষ্ঠ, আমিই শ্রেষ্ঠ, এবং এটাই আমার অন্তিম জন্ম। এ ছাড়াও এ ঐতিহাসিক বর্ষে শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্মসহ একই সঙ্গে তথাগত বুদ্ধের প্রধান সেবক আনন্দ, সাস্ত্রী কালুদায়ী, সহধর্মিণী যশোধরা, সারথী চন্দক, বেগবান অশ্ব কণ্ঠক, চারিনিধিকুম্ভ, বোধিজ্ঞান লাভের মহাবোধি বৃক্ষ, বুদ্ধত্ব লাভ এবং মহাপরিনিবা‌র্ণ প্রাপ্ত। তাই বিশ্বের বৌদ্ধসমাজে বৈশাখী পূর্ণিমার গুরুত্ব ব্যাপক তাত্পর্যপূর্ণ।

ঋতুর মধ্যে প্রধান হলো বসন্ত, তাই বসন্তকে ঋতুরাজ বলে থাকে। তিথির মধ্যেও পূর্ণিমা শ্রেষ্ঠ। মহাকারণিক তথাগত বুদ্ধ এই বৈশাখী পূর্ণিমার তিথিতেই তার জন্ম-বুদ্ধত্ব লাভ—মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। সেই বৈশাখী পূর্ণিমায় ভগবান তথাগত বুদ্ধের ত্রি-স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। চারটি সত্যের কথা ভগবান বুদ্ধ প্রচার করে গেছেন। সেই চার সত্যকে বলা হয় চার আর্যসত্য।

যথা দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ নিরোধ ও দুঃখ নিরোধের উপায়। দুঃখ নিরোধের উপায় হিসেবে আটটি পথ নির্দেশ করেছেন। সেই আট পথকে বলা হয় আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এগুলো হলো সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। বুদ্ধ প্রবর্তিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মধ্যমপন্থা। এই পন্থা একদিকে ভোগ-সুখময় এবং অন্যদিকে কঠোর তপস্যাময় জীবন থেকে সরিয়ে মানুষকে শান্তির পথে জ্ঞানমার্গে, প্রজ্ঞার পথে, বোধি লাভের পথে, পরম সুখ নির্বাণ লাভের পথে পরিচালিত করে। মধ্যমপম্হা প্রকৃতপক্ষে একটি নৈতিক বিধান, সব মানুষের কাছে যা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল। সৎ জীবনাচরণের ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন বুদ্ধ। সত্জীবন এবং জগতের অনিত্যতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করলেই মানুষ দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে।

‘বুদ্ধ’ ও ‘বৌদ্ধ’ শব্দ দ্বারা অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়েন। ‘বুদ্ধ’ বলতে জ্ঞানচক্ষু, জ্ঞানলোকে, প্রাজ্ঞ, প্রবুদ্ধ, সম্বুদ্ধ, পরমজ্ঞান, জ্ঞানী অর্থে বুঝায়। ‘বৌদ্ধ’ অর্থে সাধারণত বুদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরকে বলা হয়। বুদ্ধ নি‌ে‌র্দশিত বিনয় নীতির ওপর ধর্ম অনুসরণ করে তার জ্ঞান সাধনায় রত থেকে অনুকরণ, অনুশীলন এবং অনুধাবন করে যারা আচরণ করেন—তারাই হলেন বৌদ্ধ।

জন্মসূত্রে বৌদ্ধ হয় না, কর্মসূত্রেই বৌদ্ধ। বৌদ্ধ একটি সমষ্টিবাচক শব্দ—এই শব্দ দ্বারা একটি পরিবার, সমাজ, সম্প্রদায়, জাতি বোঝায়। কিন্তু বৌদ্ধ জাতিগত অর্থে নয়, জ্ঞান আহরণ অর্থে বোঝায়। বৈশাখী পূর্ণিমা বৌদ্ধ সমাজে কত বড় তাত্পর্যময়—তা বোঝাবার নয়। ভগবান তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ তার অন্তিমকালে বলেছিলেন ‘হন্দদানি ভিখকবে আমন্তযামি বো, বয়ধম্ম সঙ্খারা অপ্পমাদেনা সম্পাদেথা’ অর্থাৎ ‘হে ভিক্ষুগণ, তোমাদের পুনঃ বলছি, সংস্কার ধর্মসমূহ একান্ত ক্ষয়শীল, তোমরা অপ্রমত্ত হয়ে স্বীয় কর্তব্য সম্পাদন করো।’ এটাই বুদ্ধের অন্তিম বাণী। এই মহান পবিত্র দিনে দান, ধর্মালোচনা, শীল আচরণ ও ধ্যান-সাধনা একাগ্রচিত্তে সম্পাদন করে থাকেন বৌদ্ধ নরনারীর।

পরিশেষে দেশের এবং বিশ্বের সকল প্রাণীর হিতসুখ ও মঙ্গলার্থে প্রার্থনা করি সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস করুন। জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক। সাধু! সাধু! সাধু!

লেখক: বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন