শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মার্কোস তনয়ের প্রত্যাবর্তন কি ঘটতে যাচ্ছে ফিলিপাইনে

আপডেট : ১৬ মে ২০২২, ১০:৩৭

ফিলিপাইনে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাবেক একনায়ক ফার্ডিনান্ড মার্কোসের ছেলে বংবং মার্কোস জুনিয়র জিতেছেন। গণ-আন্দোলনের মুখে যে মার্কোসকে একদা ক্ষমতা ও দেশ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল, তার ছেলের হাতেই যে সেই ক্ষমতা আবার ফিরবে সেটা হয়তো কেউ কখনো ভাবেনি। ঘটনাচক্রে সে দৃশ্যই দেখতে হচ্ছে ফিলিপিনোদের। ৯ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি রেকর্ড প্রায় ৩ কোটি ভোট পান। সব ঠিক থাকলে ৩০ জুন নতুন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।

বংবং প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাসীন ভাইস প্রেসিডেন্ট লেনি রোব্রোদোর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভোট পান। মর্কোস তনয়ের ক্ষমতার শীর্ষে ফেরা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। ১৯৯২ সালে তিনি দেশটির পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য এবং ২০১০ সালে উচ্চকক্ষ সিনেটের সদস্য হন। এছাড়া একটি প্রদেশের গভর্নরের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাও তার রয়েছে।

সমালোচকদের আশঙ্কা, তিনি তার পিতার একনায়কতান্ত্রিক শাসন ফিরিয়ে আনতে পারেন। ফার্ডিনান্ড মার্কোস ১৯৬৫ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন। ১৯৬৯ সালে সিনেট তার দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতা অনুমোদন করে। ১৯৭২ সালে তিনি সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা সুসংহত করেন। ১৯৮৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে মার্কোস দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। দেশটির বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতের্তের শাসন পদ্ধতিও ছিল অনেকটা সেরকম। ধারণা করা হচ্ছে, বংবং পশ্চিমাদের পাশ কাটিয়ে চীনের সঙ্গেই সম্পর্ক জোরদার করবেন। তবে এক্ষেত্রে পূর্বসূরি দুতের্তের চেয়ে এতটুকু পার্থক্য হতে পারে যে, পশ্চিমাদের সঙ্গে কিছুটা হলেও তিনি সম্পর্ক রাখবেন। কংগ্রেসে তার দল কিলুসাং বাগং লিপুনানকে অন্য দলের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হবে।

আগেই বলা হয়েছে, বংবংয়ের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ঘটনাটি হঠাৎ করে ঘটেনি। ১৯৯১ সালে মার্কোস পরিবার নির্বাসন থেকে দেশে ফেরার পর রাজনীতিতে মনোনিবেশ করে।’ ৮৬-এর বিপ্লব ভুল ছিল, ফিলিপাইনের জনগণকে তারা এটা বোঝানোর চেষ্টা করে। এভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রের দিকে দলটি ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হয়। ৯২-এর নির্বাচনে মার্কোস পরিবার জানিয়ে দেয়, তারা একেবারে হারিয়ে যায়নি। ওই নির্বাচনে মার্কোস পত্নী সাবেক ফার্স্ট লেডি ইমেলদা একটি আসন পান। দলটি মোট ভোটের ২৩ ভাগ অর্জন করে। এর ছয় বছর পর ক্ষমতায় আসেন মার্কোস পরিবারের ঘনিষ্ঠ জোসেফ এস্ত্রাদা। মার্কোস পরিবার ও তাদের দল এরপর সময় সময় সরকারের নানা উচ্চ পর্যায়ে আসীন হয়। বংবং গত নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনি খুব সামান্য ব্যবধানে প্রতিপক্ষের কাছে হেরে যান।

৮৬-এর আন্দোলনের নাম ছিল পিপলস পাওয়ার। এর ফলে জনগণের ক্ষমতায়ন আসলে কতটুকু হয় সে প্রশ্ন থেকেই যায়। মার্কোস সহ দেশটির ধনী পরিবারগুলোর হাতেই থাকে রাজনৈতিক ক্ষমতা। ২০১১ সালে ফোর্বস সাময়িকীর তথ্য অনুসারে কংগ্রেসের ৮০ ভাগ সদস্য কোনো না কোনো ধনী পরিবারের সদস্য, যারা জিডিপির ৭৬ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করেন। আন্দোলনকারীরা বিপ্লবের ধারা পরবর্তী সময়ে ধরে রাখতে পারেনি। ফলে মার্কোস পরিবারের পক্ষে সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতার শীর্ষে উঠে আসার পথ সুগম হয়েছে। তাছাড়া বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মার্কোসপম্হিদের নিজেদের প্রচারণা চালানোর এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। মার্কোসের শাসনামলকে তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরছে ইতিহাসের সেরা সময় হিসেবে।

বংবংয়ের নির্বাচনে জয় আসলে অবশ্যম্ভাবী ছিল না সেটা বলা যাবে না। কারণ বিদায়ী প্রেসিডেন্টের মেয়ে সারা দুতের্তে ওই পদে দাঁড়াতে পারতেন। তিনি প্রেসিডেন্ট পদে না দাঁড়িয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে। আরও একজনের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার সম্ভবনা ছিল, যিনি ছিলেন ডাভাওয়ের মেয়র। কিন্তু তিনিও শেষ মুহূর্তে বংবংয়ের অনুকূলে সরে দাঁড়ান। বিরোধী সবগুলো দলের একচ্ছত্র সমর্থন পান মার্কোস তনয়। ৩ কোটি ভোট পেয়ে তিনি যে বিরোধী শিবিরকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন তা নয়। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী লিবারেল ডেমোক্রেটিক ঘরানার রোব্রেদো পেয়েছেন দেড় কোটি ভোট। তার প্রতি দেশটির সেনাবাহিনী ও তরুণ ভোটারদের এক বড় অংশের সমর্থন রয়েছে। তিনি বংবং মার্কোসের শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারেন। তাছাড়া দুতের্তে কন্যা ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়া বংবংয়ের এর জন্য খুব একটা সুখকর নয়। কারণ তিনি মূলত তার বিরোধী শিবিরের। নির্বাচনি প্রচারের সময় বিদায়ী প্রেসিডেন্ট দুতের্তে তাকে একজন দুর্বল নেতা অভিহিত করেন।

জানা গেছে, বংবংয়ে জয় ভোটারদের অনেকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। ফল ঘোষণার পর পরই ফিলিপাইনের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার ভোটার প্রতিবাদ করেছে। নির্বাচনি অফিসগুলোর সামনে তারা ‘চোর’ ‘চোর’ বলে স্লোগান দেয়। তারা ইমেলদাকে জেলে পুরারও দাবি জানায়। উল্লেখ্য, আর্থিক অনিয়মের করেন ২০১৮ সালে তার ১১ বছর জেল হয়। প্রতিবাদকারীদের একজন ২৭ বছর বয়সী ড. পলা সান্টোস বলেন, ‘আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিহাস নতুন করে লিখতে পারবো না, যা পারি তা হলো এ থেকে শিক্ষা নেওয়া।’

ইত্তেফাক/টিএ