বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শৃঙ্খলাই প্রথম ও উন্নতির সোপান

আপডেট : ১৭ মে ২০২২, ০৮:০৩

ডিসিপ্লিন ইজ ফার্স্ট বা শৃঙ্খলাই প্রথম। যে জাতি যত নিয়ম-শৃঙ্খলা মানিয়া চলে, সে জাতি ততই উন্নতির শিখরে পৌঁছাইতে সক্ষম হয়। এই আপ্ত বাক্যগুলি আমরা প্রায়শ উচ্চারণ করিয়া থাকি। কিন্তু বাঙালি জাতি হিসাবে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তাহার প্রয়োগ তেমন একটা দেখা যায় না বলিলেই চলে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র আজ বিশৃঙ্খলাই যেন সার হইয়া উঠিয়াছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরাইয়া আনিবার কথা সেই কবে হইতে বলা হইতেছে। কিন্তু এই শৃঙ্খলা কি আমরা মানিয়া চলিতেছি? চালক হইতে শুরু করিয়া পথচারী পর্যন্ত আমরা আজ কতটা সচেতনতার পরিচয় দিতেছি? যাহারা সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে রহিয়াছেন, তাহারা আজ কতটা দায়িত্বশীল? শৃঙ্খলার অভাব রহিয়াছে বলিয়া সড়ক দুর্ঘটনা আজও বন্ধ হইতেছে না। বন্ধ হইতেছে না সড়কে মৃত্যুর মিছিল।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে বলা হইয়াছে, মে মাসে পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে ও পরের ১৫ দিনে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৬ জনের মৃত্যু হইয়াছে, আহত হইয়াছে ৮৪৪ জন। আহতদের মধ্যে কত জন পঙ্গুত্ব বরণ করিয়াছে এবং মেরুদণ্ডের বিকলাঙ্গতাসহ কত ধরনের অসুখ-বিসুখে ভুগিতেছে—তাহার ইয়ত্তা নাই। সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদের দেশে যে পরিমাণে হতাহতের ঘটনা ঘটিতেছে—তাহা একটি যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতিকেও অনেক সময় হার মানায়! আমরা প্রায়শ বলিয়া আসিতেছি, এই সড়ক দুর্ঘটনার পিছনে কোনো একক কারণ দায়ী নহে। ইহার পিছনে রহিয়াছে চালকের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা, লাইসেন্সহীনতা, গাড়ির ফিটনেসের অভাব, ভাঙাচোরা রাস্তা, রোড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অভাব, সাইন-সিম্বল না থাকা, যাত্রী বা পথচারীদের অসচেতনতা ইত্যাদি। এই সকল কারণকে সামারাইজ করিলে বা সংক্ষেপে বলিতে গেলে আমরা বলিতে পারি, সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ আমাদের বিশৃঙ্খলা।

বিআরটিএতে লাইসেন্স প্রদানে দীর্ঘসূত্রতা, জটিলতা ও অনিয়ম, রাস্তা মেরামতে কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনা, চালকের যখন খুশি তখন ওভারটেকিং, যাত্রীদের প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে বচসা, পথচারীদের যত্রতত্র রাস্তা পার হওয়া, ফুটওভারব্রিজ থাকিলেও তাহা সচারচর ব্যবহার না করা, রাস্তায় জেব্রাক্রসিংসহ মোড়ে মোড়ে ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রয়োজনীয় সাইন-সিম্বল প্রদান বা তাহা সর্বদা দৃশ্যমান ও ঠিক রাখিতে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা প্রভৃতি কি কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে? দেশে এমন আঁকাবাঁকাভাবে রাস্তা তৈরি করা হয় যেখানে কর্তৃপক্ষ অনেক সময় সেখানে সাইনবোর্ড টানাইয়া লিখিতে বাধ্য হন যে, ইহা দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা। রাস্তাঘাট নির্মাণে পঞ্চাশ বা এক শত বৎসরের পরিকল্পনা ও নকশা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত থাকিলে রাস্তার দুই পার্শ্বে ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন অপরিকল্পিত ও অবৈধ স্থাপনা ও বাজারঘাট তৈরির আশঙ্কা দূর হইত বহুলাংশে। ইহাতে রোড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রতিবন্ধকতাগুলিও দূর হইত।

অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হইতেছে, এই দেশে সর্বত্র ডিসিপ্লিন বা শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এত সহজ নহে। এতদঞ্চলে মোগল, ব্রিটিশসহ বিভিন্ন বিদেশি শক্তি দীর্ঘদিন ধরিয়া শাসন করিয়াছে। তাহাদের অধিকাংশই নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করিয়া চলিয়াছে। সমৃদ্ধময় ভারতীয় উপমহাদেশ হইতে মূল্যবান সোনাদানা, হীরা, জহরত ইত্যাদি লুটপাট করিয়াছে। যেহেতু তাহাদের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করিবার বিষয়টি গৌণ ছিল, তাই এই দেশ এখনো বিশৃঙ্খল রহিয়া গিয়াছে। বিদেশি শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে আমরা বারংবার বিদ্রোহ করিয়াছি, কিন্তু শান্তি, স্থিতি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে খুব কম সময়ই। ফলে ইহার রেশ এখনো চলিতেছে এবং সর্বত্র তাহার প্রতিফলন দেখা যাইতেছে। সড়ক তাহার সামান্য নমুনা মাত্র। কিন্তু যে কোনো একটি ক্ষেত্রকে ধরিয়া আমরা নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করিতে পারি। সড়ক-মহাসড়কগুলির নিয়মিত সংস্কার, সম্প্রসারণ, বাসস্ট্যান্ড ও স্টপেজগুলির উন্নয়ন, বাস স্টপেজ ছাড়া যত্রতত্র যাত্রী উঠানামার জন্য শাস্তি নির্ধারণ, সারা দেশে বাজার ও জনবহুল এলাকায় ফুটওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস নির্মাণ, তাহার যথাযথ ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অব্যাহত রাখিতে হইবে। সড়কে নিয়মিত যে রক্তক্ষরণ হইতেছে—তাহা কমাইতেই হইবে।

ইত্তেফাক/এমআর