শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রনিল কি শ্রীলঙ্কার চার্চিল হতে পারবেন?

আপডেট : ১৯ মে ২০২২, ০৯:১৬

“এটা ‘কার্মা’। ফোনের ও প্রান্ত থেকে বলল লেখিকা গাজালক্ষ্মী প্রেমাশিবম্। শুধু গাজালক্ষ্মী একা নয়, শ্রীলঙ্কার বেশির ভাগ মানুষ, তা সে বুড্ডিস্ট হোক, হিন্দু হোক আর অন্য কোনো ধর্মের হোক, তারা ‘কার্মা’ অর্থাৎ বিধিলিপিতে বিশ্বাস করেন। শ্রীলঙ্কান মুসলিমদেরও বিশ্বাস অমন যে সবকিছু নির্ধারিত। কিন্তু তার পরও গাজালক্ষ্মীকে বললাম, তুমি কি বিশ্বাস করো, রনিলের এই প্রধানমন্ত্রী হওয়া ‘কার্মা’? উচ্চশিক্ষিতা গাজালক্ষ্মী কিছুটা ইতস্তত করল। বুঝলাম সে বিশ্বাস করে রনিল বিক্রমসিংহের এই শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হওয়া ‘বিধিলিপি’।

কিন্তু রনিল বিক্রমসিংহকে যারা খুব ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন, বিশেষ করে একসময় তার পার্টির পার্লামেন্ট মেম্বার ছিলেন, তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাস্তবে রনিল খুবই সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ। তিনি জানেন, কখন কোন কাজটি করে রাজনীতির মই বেয়ে ওপরে ওঠা যায়। তাই পার্লামেন্টে তার দলের সেই একমাত্র সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি ঐ কার্মায় বিশ্বাস করেন না। তিনি জানেন, কখন কোন কাজটি করলে রাজনীতিতে ওপরে ওঠা যায়।

রনিল বিক্রমসিংহ গত নির্বাচনে সরাসরি ভোটে পাশ করে সংসদ সদস্য হননি। শ্রীলঙ্কার নির্বাচনি পদ্ধতি অনুযায়ী তার দলের প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে গোটাবায়ে তাকে সংসদ সদস্য করেন। রনিল বিক্রমসিংহ প্রেসিডেন্ট গোটাবায়ে ও তার ভাই সদ্য পদত্যাগকারী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষেরও খুব ঘনিষ্ঠ।

রনিল বিক্রমসিংহ তার দলের একজন মাত্র ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ঐ সময়ে পশ্চিমা সাংবাদিকরা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তার দলে তো আর কেউ নেই। রনিল তাদের বলেছিলেন, চার্চিল যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন তার দলে কজন ছিলেন? চার্চিলসহ চার জন নয় কি?

চার্চিল যখন গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন সে সময়ে তার বয়স ৬৬। সে অর্থে তিনি যুবকই ছিলেন। ঐ সময়ে যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য চার্চিলকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছিল। রাজনীতিতে আসার আগে চার্চিল সামরিক বাহিনীতে ছিলেন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নৌবাহিনীতে তিনি অটোম্যান সাম্রাজ্যকে আঘাত করার যুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। তাকে কোনো পিচ্ছিল পথে প্রধানমন্ত্রী হতে হয়নি। সহজেই রাজপরিবার তাকে প্রধানমন্ত্রিত্ব নিতে আমন্ত্রণ জানায়।

অন্যদিকে রনিল বিক্রমসিংহের বয়স ৭৩ বছর। তবে প্রধানমন্ত্রিত্বের ক্ষেত্রে তিনি চার্চিলের থেকে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। রনিল এই নিয়ে পাঁচ বার শ্রীলঙ্কার প্রধানন্ত্রী হলেন। রাজনীতিবিদ হিসেবে রনিল বিক্রমসিংহ উদার ও পশ্চিমা চিন্তাচেতনার। শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট মেম্বার—শ্রীথরন, শচীন এরা কেউই রনিলকে পছন্দ করেন না—তার পরেও তারা সকলেই স্বীকার করেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি উদার চিন্তার। যদিও তামিল পার্লামেন্ট মেম্বার শ্রীথরন তাকে পুরোপুরি উদার বলেন না। তার মত, রাজাপক্ষের ভাইয়েরা যখন তামিলদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছিল সে সময়ে রনিলের মতো উদার রাজনীতিক কোনো প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা, তিনি রাজাপক্ষের ভাইদেরকে সহায়তা করেন। রনিল বিক্রমসিংহ সব সময়ই রাজাপক্ষের ভাইদের সঙ্গে একটা সমঝোতা করেই রাজনীতি করেন।

সুতরাং রনিলের এই প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ মোটেই ‘কার্মা’ নয়। এটা প্রেসিডেন্ট গোটাবায়ে ও রনিলের একটা সমঝোতার মাধ্যমেই ঘটেছে। কারণ, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়ে রাজাপক্ষে বুঝতে পারছেন, তিনি যত চেষ্টাই করুন না কেন, প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারবেন না। তিনি প্রেসিডেন্ট পদ ত্যাগ না করা অবধি শ্রীলঙ্কা শান্ত হবে না। তাকে চলে যেতেই হবে।

আর এই চলে যাওয়াকে শান্িতপূর্ণ পথে সম্পন্ন করার জন্যই কি গোটাবায়ে বেছে নিয়েছেন বিরোধী দলের হলেও তার দীর্ঘ দিনের মিত্র রনিলকে? তাছাড়া উদার রাজনীতিক হিসেবে রনিল বোঝেন, রাজনৈতিক ক্ষমতার পটপরিবর্তন যত শান্িতপূর্ণভাবে করা যায় ততই পরবর্তী সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব। বাস্তবে এখন গোটাবায়ে ও রনিল এক হয়ে গোটাবায়ের চলে যাওয়ার শান্িতপূর্ণ পথটি শ্রীলঙ্কার সংবিধানের মাধ্যমেই সম্পন্ন করতে পারেন। শ্রীলঙ্কার সংবিধানের আর্টিকেল ৩৭-এ আছে, যদি অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে প্রেসিডেন্ট তার পদে থাকতে বা কাজ করতে অসমর্থ হন; তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ করতে পারেন এবং নতুন প্রেসিডেন্ট অন্য যে কোনো মন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিতে পারেন। এমনকি প্রয়োজনে স্পিকারও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তাই সংবিধানের এই ৩৭ আর্টিকেল অনুযায়ী এখন গোটাবায়ে পদত্যাগ করেন এবং তারই পছন্দের লোক রনিল বিক্রমসিংহই প্রেসিডেন্ট হবেন। তিনি আর যা-ই হোক, রাজাপক্ষে পরিবারের বিরুদ্ধে খুব কঠোরতায় যাবেন না। বাস্তবে তাই ‘কার্মা’ নয়, রনিলের নিয়োগের এটা একটা বড় কারণ।

শ্রীলঙ্কায় আগেও ঠিক এত বড় অর্থনৈতিক ক্রাইসিস না হলেও ২০০১-এ অনেক বড় অর্থনৈতিক ক্রাইসিস হয়েছিল। সে সময়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রনিল বিক্রমসিংহ সেই ক্রাইসিসকে সামলে ছিলেন। তাই অর্থনৈতিক ক্রাইসিস সামলানোর অভিজ্ঞতা তার আছে। কিন্তু তখন শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের মোট ২২৫ জন সদস্যর ১১৭ জনই ছিলেন রনিলের নিজের দলের। অর্থাৎ সংসদে তার মেজরিটি ছিল। এখন তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হয়ে যান, তাহলে প্রশ্ন আসবে এই সংসদের ২২৫ জনের মধ্যে যারা পদত্যাগ করেছেন তারা ফিরে এসে সব দল মিলে কি সর্বদলীয় সরকার গঠন করবেন, না নতুন নির্বাচনে যেতে হবে?

এর পরেই আসছে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে কীভাবে? চায়নার গ্লোবাল টাইমসের নিউজ অনুযায়ী, রনিল চায়নার সকল প্রকল্প চালু রাখতে চেয়েছেন তাদের রাষ্ট্রদূত তার সঙ্গে দেখা করার পরে। তবে বাস্তবে রনিল কোনো অপরিচিত এবং অনভিজ্ঞ রাজনীতিক নন। তিনি এ মুহূর্তে কোনো প্রকল্পই বাতিল করতে যাবেন না এবং কোনো দেশকেই দূরে ঠেলবেন না। তবে শ্রীলঙ্কান রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রনিল মূলত উদার ও পশ্চিমাপন্থি একজন রাজনীতিক। তারা আরো স্পষ্ট করে বলেন, যদি ভারত ও চায়নার ভেতর পছন্দের বিষয় এসে দাঁড়ায় তখন রনিল ভারতের পক্ষে থাকবেন। আর যদি পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারতের মধ্যে রনিলকে পছন্দ করতে বলা হয়, তাহলে রনিল নিঃসন্দেহে পশ্চিমা বিশ্বকে পছন্দ করবেন।

এর থেকে ধরে নেওয়া যায়, রনিল মূলত ইন্দো-প্যাসিফিক জোটসহ গোটা পশ্চিমা বিশ্বকেই কাছে টানবেন। অর্থাৎ এ মুহূর্তে চায়নাকে সম্পূর্ণরূপে দূরে ঠেলে না দিলেও তিনি মূলত আমেরিকা, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও ভারতের দিকে বেশি ঝুঁকে কাজ করবেন এবং সেটা তার দেশের অর্থনৈতিক এই ক্রাইসিস কাটিয়ে ওঠার জন্যও প্রয়োজন এবং এখন তাকে অর্থনৈতিক বিষয়ে অনেক চিন্িতত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেমন রাজাপক্ষে পরিবার মূলত তামিল গণহত্যা করার ফলে মানবাধিকারের প্রশ্নে পশ্চিমা বিশ্বে অগ্রহণযোগ্য হলে বেশি মাত্রায় চায়নার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এবং চায়না তার চিরাচরিত কাজই করে। ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয় অবকাঠামো তৈরিতে, যাতে আয় খুব বেশি নয়। অন্যদিকে ১.৮ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে শ্রীলঙ্কার কাছে। আর এ কাজের ফলে এশীয় ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের পরেই শ্রীলঙ্কাতে বেশি বিনিয়োগকারী জাপানকে চায়না শ্রীলঙ্কান সরকারের কাছ থেকে দূরে ঠেলতে সমর্থ হয়। ঠিক একইভাবে তারা ইন্ডিয়াকেও দূরে ঠেলে দিতে সমর্থ হয়। অন্যদিকে, জাপান যেখানে মাত্র ০.৭ শতাংশ সুদে ঋণ দিত সেখানে চায়নার ঋণের সুদ ৩.৩ শতাংশ। তাছাড়া জাপানের ঋণের ম্যাচুরিটিকাল যেখানে ৩৪ বছর, এমনকি ইন্ডিয়ার ২৪ বছর, সেখানে চায়নার মাত্র ১৮ বছর।

জাপান পশ্চিমাদের সহযোগী। ভারতও এখন পশ্চিমাদের মিত্র। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থাগুলো অনেক বেশি পশ্চিমা বিশ্বনিয়ন্ত্রিত। তাই পশ্চিমাদের আদর্শের বিশ্বস্ত রনিল যদি এই পার্লামেন্ট নিয়ে সর্বদলীয় সরকার গড়তে পারেন এবং গোটাবায়কে শান্িতপূর্ণভাবে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারেন—তাহলে অর্থনৈতিক বিষয়ে শ্রীলঙ্কার নীতি ভিন্ন হবে। তখন অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য চায়না থেকে সম্পূর্ণ মুখ না ফেরালেও তার মুখ এশিয়ায় জাপান ও ভারতের দিকে যেমন থাকবে তেমিন মূলত পশ্চিমা বিশ্বের দিকে রাখতে হবে তাকে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চার্চিলের গ্রেট ব্রিটেনের মানুষ কৃচ্ছ্রসাধন করে চার্চিলকে সহায়তা করেছিলেন। কিন্তু তার বিপরীতে দেখা যাচ্ছে, শ্রীলঙ্কায় এ মাসের বেতনে সরকারি ডাক্তারদের অতিরিক্ত সুবিধাটুকু কাটা হয়েছে বলেই ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের অ্যাসোসিয়েশন সরকারকে চিঠি দিয়েছে। যেন এটা না কাটা হয়। তার অর্থ সেখানে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে মানুষের দুর্গতির প্রতি কোনো সহানুভূতি নেই। মানুষ যেখানে তার খাবার কিনতে পারছে না সেখানে তারা তাদের বাড়তি সুবিধা চাইছে। অন্যদিকে ছয় বারের প্রধানমন্ত্রী হলেও রনিলের বিরুদ্ধে যেমন দুর্নীতির অভিযোগ আছে তেমনি তিনি গোটাবায়ে পরিবারকে সুবিধা দিলে জনগণ কি শেষ অবধি তার পেছনে এসে দাঁড়াবে?

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত।

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন