আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর। কি ব্যক্তিগত কি পারিবারিক। গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে সেই সম্পর্ক। আমার বয়স তখন কম। আমার সৌভাগ্য, আমার শৈশব থেকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতো বড় মাপের মানুষটির সান্নিধ্য পেয়েছি। তার স্নেহ পেয়েছি, উপদেশ, পরামর্শ, দিকনির্দেশনা পেয়েছি আমি এবং আমার পরিবারের সদস্যরাও। এত বড় মাপের একটি মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা মনে এলে ভাবি—তিনি তো গোটা দেশের মানুষের কাছেই ঘনিষ্ঠতর। হবেন না কেন, পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে যখন এই দেশের মানুষের মন-মানসিকতা অসাম্প্রদায়িকতায় পরিপূর্ণ, সেই মানুষের মনো-চাহিদাকে পূরণ করার জন্য তার কৈশোর থেকে তিনি জড়িয়ে যান। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তার অমর কবিতার কারণে তিনি আজ ইতিহাসের অংশ। কিন্তু তিনি কি শুধুই ভাষাসংগ্রামী ছিলেন? তার সৃষ্টির মাত্রা ছিল বহুমাত্রিক। কবিতায় তিনি কালজয়ী হয়েছেন, তার কথাশিল্পে পারদর্শিতার কথা কি বাদ দেওয়ার সুযোগ আছে? তার অনেক গুণই আজো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। তিনি ছিলেন আপসহীন এক মানুষ। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি নিজের চিন্তা-চেতনা ও বিবেককে স্বার্থের কারণে কখনো বিক্রি করে দেননি। তিনি যখন ‘আওয়াজ’ বের করেন, তখন ছয় দফার কাল। ছয় দফাকে মানুষের কাছে নেওয়ার ক্ষেত্রে তার যে ভূমিকা সে কথা কি ভুলে থাকা সম্ভব? বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতা লাভের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল তার সেসব আপসহীন জীবন। পাকিস্তানের গোড়ার দিক থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা পরবর্তীকালে আমাদের দেশের অসাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় তিনি ছিলেন সোচ্চার।
একজন লেখক, একজন সাংবাদিক এবং একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে তার বড় একটি শক্তি ছিল—সেটা ছিল তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। প্রতিটি ঘটনাকে তিনি তার অতীতের অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে সাজিয়ে তুলতেন—যা পাঠককে দ্রুত কাছাকাছি টানার মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। তার চিন্তাভাবনাগুলো ছিল স্বচ্ছ। তিনি যা ভাবতেন, বিশ্বাস করতেন—অকপটে তিনি বলতেন। পরিণতিতে তার কী সমস্যা হতে পারে—তা তিনি মোটেও ভাবতেন না। এর জন্য তাকে ভোগান্িতও পোহাতে হয়েছে অনেক। বাংলাদেশের দুই সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের আমলে তার দেশে আসার পথে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। তিনি কিন্তু থোড়াই তোয়াক্কা করেছেন সেসব।
স্নেহের দাবি নিয়ে অনেক সময় তার কাছে পরামর্শ চাইতাম। কি লন্ডনে কি দেশে—যেখানেই তিনি থাকতেন আমাকে পরামর্শ দিতেন। আমি তার তুলনায় নগণ্য হওয়ার পরও অনন্য স্নেহ পেয়েছি তার কাছ থেকে। এমন মহিরুহ একটি দেশে যুগে যুগে জন্মায় না। আজকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শোকবার্তায় সেরকমই মন্তব্য করেছেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তার সৃষ্টি থাকবে—যত দিন বাংলাদেশ থাকবে।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ