শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

হায় রে বুড়িগঙ্গা নদী!

আপডেট : ২১ মে ২০২২, ০৪:৩৪

ঢাকার পশ্চিমে বুড়িগঙ্গার শাখা নদী বালু দিয়ে ভরাট করে দখলের মহোত্সব চালাচ্ছে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা। প্রধানমন্ত্রী ও উচ্চ আদালতের বারবার নির্দেশের পরও ঢাকার খোলা জানালা হিসেবে পরিচিত বুড়িগঙ্গা নদীর শাখা-প্রশাখার দুই তীর দখলে মেতে উঠেছে তারা। ফলে বুড়িগঙ্গা দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে মোহাম্মদপুর, লালবাগ, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার শাখা নদীর প্রায় ২৪ হাজার ৫০০ কাঠা (৩৫০ একর) দখল হয়ে গিয়েছে, যার অনুমানিক মূল্য ৫০০ কোটি টাকা। 

বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষণাবেক্ষণে কর্তৃপক্ষীয় কোনো উদ্যোগ নেই। যেভাবে বুড়িগঙ্গার শাখা-প্রশাখা দখল করা হচ্ছে, তাতে একসময় রাজধানীর নিম্নাঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। বিগত জোট সরকারের আমলে গাবতলী থেকে শুরু করে লালবাগ নবাবগঞ্জ সেকশন পর্যন্ত পশ্চিমের শাখা নদী বালু দিয়ে ভরাট করেছে ভূমিদস্যুরা। বুড়িগঙ্গার পশ্চিমের শাখা নদীটি পুরানো চ্যানেল ছিল। এখান দিয়ে একসময় লঞ্চ, স্টিমার, বড় বড় ইঞ্জিন বোটসহ নানা নৌযান চলাচল করত। নদীর স্রোতের কলকল ধ্বনি দূর থেকে শোনা যেত। হাক্কুল এবাদ লোহার ব্রিজ থেকে ব্যাটারীঘাট, কুড়ারঘাট ও শহীদনগর বালুর ঘাট সংলগ্ন বুড়িগঙ্গার শাখা নদীর প্রায় ৩২৫ কাঠা জায়গা বালু দিয়ে ভরাট করার পাঁয়তারা করছে ভূমিদস্যুরা। জমিগুলো সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত। বেড়িবাঁধ ঘেঁষে নদীর জায়গা বালু দিয়ে ভরাট করার সঙ্গে সঙ্গে এই জমি বেশির ভাগই নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা জেলা প্রশাসন সূত্র থেকে জানা যায়, লালবাগ, হাজারীবাগ এবং কামরাঙ্গীচরের মধ্য দিয়ে গত শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা দিয়ে স্বচ্ছ পানি প্রবাহিত হতো। 

চল্লিশের দশকে বুড়িগঙ্গা দখল শুরু হয়। আশির দশক থেকে নদী ভরাট করে ঘরবাড়ি নির্মাণের হিড়িক পড়ে। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছন (দক্ষিণ) থেকে নবাবগঞ্জ হাজারীবাগ, গাবতলী, মিরপুর হয়ে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করায় বাঁধটির ভেতরে বুড়িগঙ্গার বিশাল এলাকা পড়ে যায়। জালিয়াতরা বাঁধের ভেতরে পড়া নদীর জমি পুরোটা গ্রাস করে। আশির দশকে তুরাগের ডান তীরে মরা বুড়িগঙ্গার প্রবেশমুখে সিকদার মেডিক্যালের পাকা হাসপাতাল নির্মিত হলে বুড়িগঙ্গার এ অংশটির অপমৃত্যু ঘটে। বুড়িগঙ্গার কী পরিমাণ জমি বেহাত হয়েছে তার যথাযথ হিসাব ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া যায়নি। অথচ নদী তথা সরকারের খাস জমি দেখভাল করার দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। একটি সূত্র আনুমানিক হিসাব দিয়ে বলেছে, লালবাগ, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় বেহাত হওয়া জমির পরিমাণ প্রায় ৩৫০ একর। এর মধ্যে ২৫০ একর জমি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে এবং ১০০ একর জমি বাঁধের ভেতরে। 

জানা গেছে, পুরান ঢাকার লালবাগের সোয়ারীঘাট থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে কামরাঙ্গীরচরের মূল প্রবেশদ্বার হাক্কুল এবাদ ব্রিজ থেকে একটু এগিয়ে গেলেই বড়গ্রাম, কুড়ারঘাট, পূর্ব রসূলপুর, পশ্চিম রসূলপুর এলাকার কোল ঘেঁষে বুড়িগঙ্গা নদীর একটি শাখা বেরিয়ে গেছে—যা লালবাগ, নওয়াবগঞ্জ বড় মসজিদ ঘাট বেড়িবাঁধ বাজার, হাজারীবাগের ট্যানারি, রায়েরবাজার, বসিলা, কাটাসুর হয়ে আবার মূল নদীতে এসে পড়েছে। বেরিয়ে যাওয়া এই অংশটি বুড়িগঙ্গার পশ্চিমের শাখা নদী হিসেবে পরিচিত। এরশাদ সরকারের আমলে গাবতলী হয়ে তুরাগ নদী পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল রাজধানীকে বন্যামুক্ত করার পাশাপাশি বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য বাড়ানো। এজন্য বাঁধের ওপর কংক্রিটের রাস্তা নির্মাণ করা হয়। একসময় ভাবা হয়েছিল, বুড়িগঙ্গাকে টিকিয়ে রাখার জন্য নদীর দুই পাড়ে এভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণ (ওয়াকওয়ে) করা হবে। আর নদী ঘিরে ফ্লাইওভার নির্মাণ করে বাড়ানো হবে রাজধানীর সৌন্দর্য। ৯০ দশকে বুড়িগঙ্গার এই শাখা নদীতে দখলের মহোত্সব শুরু হয়। পশ্চিমের শাখা নদী বেড়িবাঁধ ঘেঁষে সিটি করপোরেশন ময়লা-আবর্জনা ফেলতে শুরু করে। ফলে এর আশপাশে কয়েকটি মহল্লার লাখ লাখ বাসিন্দা দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ। 

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কামরাঙ্গীরচর ২ নম্বর পূর্ব রসূলপুর হাফেজ মুসা পাকা ব্রিজ ঘেঁষে নদী বালু-মাটি দিয়ে ভরাট করে দোকানপাট গড়ে তোলা হয়েছে। এই ব্রিজের ১০০ গজ দূরে নওয়াবগঞ্জ সেকশন ও কামরাঙ্গীরচর রনি মার্কেট সংযোগ স্হলে নির্মিত পাকা ব্রিজ ঘেঁষে নদীর বিশাল অংশ দখল করে মার্কেট ও বসতঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছে একটি মহল। এই নদীর ওপর জেলা প্রশাসকের নির্দেশে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করায় পশ্চিমের নদী দখলের মহোত্সব আবার শুরু হয়। নদী ও বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘেঁষে নদীর বিশাল অংশ জুড়ে প্রথমে বাঁশের খুঁটি দিয়ে দখল করে পরে বালু দিয়ে ভরাট করা জায়গায় গড়া হয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিশাল ফ্যাক্টরি। দেখাদেখি অনেকে হাজারীবাগ বসিলা পর্যন্ত বিস্তৃত অংশ বেড়িবাঁধ ঘেঁষে বালু ভরাট করে দখল পাকাপোক্ত করেছে। 

এছাড়া বসিলা থেকে গাবতলী পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার শাখা নদীর বুকে আধুনিক বহুতল ভবন এবং কল-কারখানা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। অচিরেই বুড়িগঙ্গার শাখা নদী দখলমুক্ত করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি শহর রক্ষা বাঁধের ১৫টি স্লুইজগেট পুনরুদ্ধার করা না হলে নগরবাসী স্থায়ী জলাবদ্ধতার কবলে পড়বে। ২০০০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ৩৬ নম্বর জলাধার সংরক্ষণ আইনের ২-এর (চ) ধারা পাশ হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বুড়িগঙ্গা নদীসহ দেশের চারটি নদী ও খাল-বিল দখলমুক্ত করার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকার পরেও চিহ্নিত ভূমিদস্যুদের কার্যক্রম থামেনি।

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন