বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশ্ব মেডিটেশন দিবস আজ

আপডেট : ২১ মে ২০২২, ১৫:২৬

আজ ২১ মে, বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। মনের সার্বজনীন ব্যায়াম হচ্ছে ধ্যান বা মেডিটেশন। যেকোনো বয়সের মানুষ প্রতিদিনই এটি চর্চা করতে পারেন। 

মেডিটেশনের নিয়মিত অনুশীলন জাগিয়ে তোলে মানুষের ভেতরের ইতিবাচক সত্তাকে, শুভ শক্তিকে। নিয়মিত মেডিটেশন চর্চায় মনের রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ হতাশা, দুশ্চিন্তা, স্ট্রেস বা মানসিক চাপ দুর হয়। নেতিবাচকতা থেকে ইতিবাচকতায় বদলে যায় দৃষ্টিভঙ্গি। মন প্রশান্ত থাকলে, মনে মমতা জাগলে পারিবারিক, পেশাগত, সামাজিক সম্পর্কগুলোও সুন্দর হয়ে ওঠে। মানসিক চাপমুক্ত থাকা যায় বলে বাড়ে পেশাগত দক্ষতা। শুধু নিয়মিত মেডিটেশন চর্চা করেই একজন মানুষ পেতে পারেন প্রশান্তি, সুস্বাস্থ্য ও সাফল্য। এসব প্রেক্ষাপট সামনে রেখে বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হবে।

বিশ্বজুড়ে এখন প্রায় ৫০ কোটি মানুষ নিয়মিত ধ্যান বা মেডিটেশন করেন। গত কয়েক বছর ধরে পৃথিবীজুড়ে কিছু প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের উদ্যেগে ২১ মে বিশ্ব মেডিটশন দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা ও বয়সের মানুষ এতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছেন। উজ্জীবিত হচ্ছেন শক্তি ও উদ্যোমে। নতুন গতি অনুভব করেছেন স্বাস্থ্য ও মনে।

বিশ্ব মেডিটেশন দিবস আজ।

বাংলাদেশে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস পালনের মূল উদ্যোক্তা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। এই সংগঠনের উদ্যোগে আজ শনিবার (২১ মে) ফাউন্ডেশনের সেল, প্রিসেল, শাখা, সেন্টারসহ দুই শতাধিক উন্মুক্ত স্থানে সাংগঠনিকভাবে এবং ঘরে ঘরে ব্যক্তিগতভাবে লাখ লাখ মানুষ সম্মিলিত মেডিটেশনে অংশ নেবেন। 
এদিন বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে সকাল সাড়ে ৬টায় সারা দেশে এবং দেশের বাইরে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন শাখা ও ভার্চুয়াল সেলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ধ্যানমগ্ন হবেন। ‘ভালো মানুষ ভালো দেশ স্বর্গভূমি বাংলাদেশ’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে দিবসটি পালনে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী মানবিক সংগঠন কোয়ান্টাম। দিবসটি উপলক্ষে শুধু একদিনের আয়োজন নয়, মাসব্যাপী আয়োজিত হচ্ছে শিশু-কিশোরসহ সব বয়সের মানুষের জন্যে রচনা, চিত্রাঙ্কনসহ নানা প্রতিযোগিতার। 

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ‘আমার মতে জগৎটাতে ভালোটারই প্রাধান্য মন্দ যদি তিন চল্লিশ, ভালোর সংখ্যা সাতান্ন’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বাণী বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেন ধ্যানীরা। অন্তত নিজের জীবনে তো বটেই! নিয়মিত মেডিটেশন চর্চাকারীরা বোঝেন মেডিটেশন বা ধ্যানচর্চা একজন মানুষের ভেতরে কীভাবে শুভ শক্তি বা ভালো বৈশিষ্ট্যগুলোকে জাগিয়ে তোলে। নিয়মিত মেডিটেশন চর্চাকারীর মনের ভেতর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আত্মবিশ্বাস, সাহস, সমমর্মিতা, পরার্থপরতা, দেশপ্রেমসহ যাবতীয় মানবিক গুণাবলী। পাশাপাশি এ চর্চা ‘মন্দ’ জিনিসগুলোকে মুছে ফেলতে সাহায্য করে। এই মন্দের ভেতর রয়েছে রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, ঈর্ষা, লোভ, লালসা, অহম, হীনম্মন্যতা, ভয়, দুশ্চিন্তা, নেতিচিন্তা, অবিশ্বাস আর সংশয় ইত্যাদি সকল আত্মবিধ্বংসী উপাদান। সব মিলিয়ে মন্দ মুছে মন হয় ময়লামুক্ত। 

মেডিটেশন হচ্ছে সেই কৌশল বা প্রক্রিয়া; যা এ দেশের ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে হাজার বছর ধরে। সর্বস্তরে এ চর্চা আবারো ছড়িয়ে গেলে মানুষের ভেতরের ভালো সত্ত্বাটি অধিক সক্রিয় হয়ে উঠবে। জগতে ভালোর ভাগই বেশি। আর প্রত্যেক মানুষের ভেতর ভালো সত্ত্বাটির অংশই বেশি থাকে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক নানা চাপে অনেক সময় মন্দ সত্ত্বাটি অধিক শক্তিমান হয়ে ভালো সত্ত্বাকে চেপে ধরে। মেডিটেশন তখন সেই ভালো সত্ত্বাটিকে বাঁচিয়ে তোলে। 

২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হচ্ছে দিনটি। দিবস পালনের বিষয়টি আসলে প্রতীকী। যখন কোনো সমাজ বা জনগোষ্ঠীকে কোনো বিষয়ে সচেতন করার প্রয়োজন হয়, গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে কথা বলার প্রেক্ষাপট হয়; তখন একটি দিনকে নির্দিষ্ট করে সেদেশের সরকার সংগঠন বা জাতিসংঘ এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। সেভাবেই উদ্ভব হয় বিশ্ব মেডিটেশন দিবসের। 

[সংগৃহীত প্রতীকী ছবি]

বছর পাঁচেক আগে উইল উইলিয়ামস নামে এক ব্রিটিশ মেডিটেশন প্রশিক্ষক প্রথম এ দিবসটি পালনের উদ্যোগ নেন। উইল উইলিয়ামস অনিন্দ্রার রোগী ছিলেন। মেডিটেশনের মাধ্যমে নিরাময়ের পর তিনি এ সম্পর্কে আরো উৎসাহী হয়ে ওঠেন। গভীর ধারণা লাভের জন্যে তিনি ভারতে এসে সেখানকার দুজন গুরুর সান্নিধ্য লাভ করেন। সেই সাথে চীনা, মিশরীয় ও অ্যামাজন অঞ্চলের ধ্যান সম্পর্কে পাঠ নেন। এক পর্যায়ে ’বিজা’ মেডিটেশন নামে একটি ধ্যান পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। যার মূল সুর উৎসারিত হয়েছে প্রাচ্যধারার ধ্যানপদ্ধতি থেকে।

এদিকে কোয়ান্টাম মেথড গত তিন দশক ধরে বাংলা ভাষায় সবচেয়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় মেডিটেশন পদ্ধতি। চার দিনের মেডিটেশন কোর্স সম্পন্ন করে এ পর্যন্ত লক্ষাধিক মানুষ সরাসরি এবং অ্যাপ, বই, উন্মুক্ত ফ্রি প্রোগ্রাম ও কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে উপকৃত হয়েছেন আরো লাখো মানুষ। সেজন্যেই ২০২১ সালে কোয়ান্টাম উদ্যোগ নেয় বিশ্ব মেডিটেশন দিবস উদযাপনের। ক্রমে দিবসটি হয়ে উঠছে উৎসবমুখর। 

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বাসার খান বলেন, যখন একটি দেশের জনসংখ্যার বড় অংশের ভেতরের ‘ভালো মানুষ’টি সক্রিয় হয়ে ওঠে, সজাগ হয়ে ওঠে; তখনই দেশটি হয়ে ওঠে ভালো দেশ। আমাদের স্বপ্ন- প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে ভালো মানুষের ভালো দেশে রূপান্তর করা, স্বর্গভূমিতে রূপান্তর করা। সেজন্যেই প্রয়োজন ভালো মানুষ। আর প্রতিটি মানুষকে ভালো তথা শুদ্ধাচারী মানুষে রূপান্তরের জন্যেই প্রয়োজন মেডিটেশনের চর্চা। মানুষ ভালো হলে, ভালো মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলে আমাদের জাতিগত মনছবি ধাপে ধাপে তার স্বপ্নের দিকেই এগিয়ে যাবে। 

ইউনাইটেড হসপিটাল এর সাইকিয়াট্রি ডির্পারমেন্ট এর কনসালটেন্ট ডা. জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, স্ট্রেস বা মানসিক চাপ নিয়ে যখন একজন মানুষ ধ্যানমগ্ন হন বা মেডিটেশন করেন তার ট্রেসের মাত্রা কমে যায় শতকরা ৬০ ভাগ। গবেষণার তথ্য, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার অন্তত ৮৭ ভাগ কমে গেছে যখন তারা মেডিটেশন করেছেন। শতকরা ৯১ ভাগ মানুষই মেডিটেশন করে বাদ দিতে পেরেছেন ঘুমের ওষুধ বা স্লিপিং পিল খাওয়া। কোনো ওষুধ বা প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে এমন সাফল্য কখনো দেখা যায়নি। এই ধ্যান বা মেডিটেশন হলো দম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজের মনের ভিতর ডুব দেয়া, ইতিবাচক বিষয় নিয়ে ভাবা, সুখ বা সাফল্যের কথা চিন্তা করা। মেডিটেশনের মাধ্যমে সাফল্য, প্রশান্তি ও নিরাময় লাভ করেছেন লাখ লাখ মানুষ। প্রায়োগিক কার্যকারিতায় বিশ্বজুড়ে মেডিটেশন হয়ে উঠেছে নিরাময়ের বিকল্প পদ্ধতি, সাফল্যের অব্যর্থ প্রক্রিয়া ও প্রশান্তির লাগসই টেকনিক। এজন্য বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও লাখ লাখ মানুষ ধ্যান বা মেডিটেশন করে নিজেদের জীবন-যাপনকে করে তুলেছেন অর্থবহ।

মনীষীদের ভাষায়, মানবজীবনের একক হচ্ছে প্রশান্তি। প্রশান্তি ছাড়া অর্থ-বিত্ত, খ্যাতি, সাফল্য সবকিছুই অর্থহীন। সেই প্রশান্তির খোঁজ মিলছে মেডিটেশনে। ইতিবাচক চিন্তার মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ সমস্যা ও দুর্দশাগ্রস্ত প্রাত্যহিক জীবন বদলে ফেলেছেন। নিরাময় লাভ করেছেন দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে। কাঙ্ষ্খিত সাফল্য এসেছে হাতের মুঠোয়। ২০১৮ সালের এক জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৫২ ভাগ প্রতিষ্ঠানই তাদের কর্মীদের মেডিটেশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কারণ, তারা দেখছে, মেডিটেশন করা কর্মীর উৎপাদন ক্ষমতা মেডিটেশন না করা কর্মীর চেয়ে শতভাগ বেশি। বাংলাদেশের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও সেদিকে ঝুঁকছে।

 

ইত্তেফাক/এমআর

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন