বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কিশোর অপরাধপ্রবণতা ও প্রতিকার

আপডেট : ২২ মে ২০২২, ০৬:৪৭

শিশু-কিশোররাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। শিশু-কিশোররা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠলেই দেশ ও জাতির উন্নতি ও অগ্রগতি নিশ্চিত হয়। প্রকৃতপক্ষে তাদের এ বয়সটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন, ‘তেরো-চৌদ্দ বত্সরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই’।

এ বয়সে শিশু-কিশোররা রঙিন স্বপ্ন দেখে। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশের কারণে তারা অনেক সময় আশাভঙ্গের বেদনায় ব্যথিত হয়ে অপরাধ জগতের অন্ধকারে পতিত হয়। যার ফলে সমাজে প্রায়শই নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ঘটনা ঘটে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হয়। কিশোর অপরাধের ভয়াবহ পরিণতি উপলব্ধি করতে পারেন কেবল ভুক্তভোগী পিতামাতাই। তাই সমাজের দায়িত্ববান সবার উচিত কিশোর অপরাধপ্রবণতা প্রতিরোধে সচেষ্ট হওয়া ও কিশোর অপরাধীদের অন্ধকার জগৎ থেকে আলোর দিকে ফিরিয়ে আনতে উদ্যমী হওয়া এবং যথাযথভাবে বেড়ে উঠার জন্য সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সি যে কোনো মানুষ যখন কোনো অপরাধে লিপ্ত হয়, তখন সেই অপরাধকে কিশোর অপরাধ বলে। প্রাপ্তবয়স্করা সাধারণত সুচিন্তিতভাবে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে অপরাধমূলক কাজ করে থাকে। কিন্তু, কিশোররা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কৃতঅপরাধের পরিণাম ফল চিন্তা না করে পরিবেশ ও আবেগের বশবর্তী হয়ে বিভিন্ন প্রকার অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। কিশোর অপরাধীরা তাদের সঙ্গীসাথীদের নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে বড় ধরনের অপরাধ করে থাকে, যা কিশোর গ্যাং নামে পরিচিত।

বর্তমানে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই ৭৮টির বেশি কিশোর গ্যাং সক্রিয় আছে এবং কমপক্ষে ৫১ জন গডফাদার ইন্ধন জোগাচ্ছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ। এসব কিশোর গ্যাং-এ ২ হাজারেরও বেশি সক্রিয় সদস্য রয়েছে। তারা বিভিন্ন চমকপ্রদ নামে পরিচিত। ঢাকা মোহাম্মদপুরে ফিল্ম ঝির ঝির, আতঙ্ক, স্টার বন্ড, গ্রুপ টোয়েন্টি ফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল এবং কোপাইয়া দে গ্যাং গ্রুপ। তেজগাঁওয়ে মাঈনুদ্দিন গ্রুপ, উত্তরায় নাইন স্টার, পাওয়ার বয়েজ, বিগ বস, নাইন এম এম বয়েজ, সুজন ফাইটার, ক্যাসল বয়েজ, আলতাফ জিরো, ভাইপার, তুফান এবং ত্রি গোল গ্যাং। মিরপুরে সুমন গ্যাং, পিচ্চি বাবু, বিহারী রাসেল, বিচ্চু বাহিনী, সাইফুল গ্যাং, বাবু রাজন, রিপন গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, নয়ন গ্যাং এবং মোবারক গ্যাং। বংশালে জুম্মন গ্যাং গ্রুপ, ধানমন্ডিতে রয়েছে একে ৪৭, নাইন এম এম ও ফাইভ স্টার বন্ড গ্যাং গ্রুপ। রাজধানীর মুগদায় চান জাদু (জমজ ভাই), ডেভিল কিং ফুল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারী গ্যাং গ্রুপ। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং বিভিন্ন চমকপ্রদ নামে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া কিছু কিশোর অপরাধের লোমর্হষক ঘটনা জনমনে চিন্তার উদ্যেগ করেছে।

কিশোর অপরাধপ্রবণতার কারণসমূহ অনুসন্ধানে প্রথমেই যে বিষয়টি বিবেচনায় আসে তা হলো ঝুঁকিপূর্ণ সামাজিক অবস্থা। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০-৩২ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৪ কোটি শিশু-কিশোর। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের অধিক প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ শিশু-কিশোর বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। ফলে অতি সহজেই তাদের যে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এজন্য পরিবার এবং সমাজই হলো সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠার প্রধান ভিত্তি। পিতামাতার মধ্যে মনোমালিন্য ও কলহবিবাদ থাকলে সন্তানের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। যার পরিণামে শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণ হতে বিশেষভাবে সাহাঘ্য করে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রভাবও শিশু-কিশোরদের গড়ে উঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার অন্তর্নিহিত তাত্পর্য, ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক সোহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক, ছাত্রছাত্রীর নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অনুশীলন ও শিক্ষার অভাব বিরাজমান। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য গঠনমূলক সুষ্ঠু চিত্তবিনোদন, খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধা ও সুষ্ঠু মেধা বিকাশের সুযোগের অভাবও প্রকট। বর্তমান সমাজে অনেক চাকরিজীবী পিতামাতার চাকরিজনিত কারণে ঘন ঘন বদলির ফলে বাচ্চাদের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ ও সংহতির অভাব পরিলক্ষিত হয়। নতুন পরিবেশে নতুন সামাজিক ও সংস্কৃতির সঙ্গে তারা নিজেদেরকে খাপ খাওয়াতে হিমশিম খায়।

‘সত্ সঙ্গে স্বর্গ বাস আর অসত্ সঙ্গে সর্বনাশ’—কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে এ প্রবাদটি বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ। এই বয়সে কিশোর-কিশোরীরা পরিবারের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে চলতে চায়। এ সময় তারা পাড়া-প্রতিবেশি, খেলার সঙ্গী ও সমবয়সিদের সঙ্গে মিশে সঙ্গপ্রভাবে অত্যন্ত সহজে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন শিক্ষা লাভ করে থাকে। এ সময় অপরাধপ্রবণ বন্ধু এবং সমবয়সিদের সঙ্গে তাল মিলাতে অনেক সময় কিশোর-কিশোরীরা জঘন্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো কিশোর-কিশোরীদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে কিশোর-কিশোরীদের কাছে পর্নোগ্রাফি সাইট উন্মুক্ত-তিন হয়ে পড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা সহজেই পর্নোগ্রাফি এবং অশ্লীল ভিডিও চিত্র অতি সহজেই পেয়ে যাচ্ছে। যার মাধ্যমে তাদের অপরিপক্ব মানসিকতায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশু ও কিশোরদের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের জন্য এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি শিশু আইন-১৯৭৪ প্রণয়ন করেছিলেন। তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের অনুসরণে শিশু আইন ১৯৭৪-কে আরো যুগোপযোগী করে শিশু আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেন। জাতিসংঘ কতৃ‌র্ক বেঁধে দেওয়া বয়সসীমার পরিপ্রেক্ষিতে শিশুদের ক্ষেত্রে ১৩ বছর পর্যন্ত এবং কিশোরদের ক্ষেত্রে ১৩-১৮ বছর পর্যন্ত এই আইনের আওতায় পড়ে। কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনাসহ সমাজে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের যাবতীয় কার্যক্রম এ আইনে উল্লেখ রয়েছে।

১৯৭৬ সালে ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে প্রতিষ্ঠিত হয় কিশোর আদালত, কিশোর হাজত এবং সংশোধন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে জাতীয় কিশোর অপরাধ সংশোধন ইনস্টিটিউট। শিশু-কিশোরদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এবং অপরাধপ্রবণতা থেকে দূরে রাখতে বর্তমান সরকার দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তুলেছেন। এ সংক্রান্ত আইনকানুন ও নীতি যুগোপযোগী করা হয়েছে। মাতাপিতা ও অভিভাবকদের অনুপস্থিতিতে অনাথ শিশুদের দায়িত্ব সরকার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিচ্ছেন। এসব শিশু-কিশোরদের খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিত্সাসহ বিভিন্ন মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করে সরকারি শিশু পরিবার, সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র, দুস্হ শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র, ছোটমণি নিবাস প্রভৃতি নানা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ প্রবণতা কমাতে এবং শিশু-কিশোরদের সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের প্রয়াসে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রায় ৮ হাজার ক্লাব শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করছে। কিশোর অপরাধ সংশোধনে এসব ক্লাব খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিশোর অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদাতত্পর।

‘সবার হোক একটাই পণ, কিশোর অপরাধ করব দমন’— এই ‌স্লোগানকে সামনে রেখে র‌্যাব ফোর্সেস লিড এজেন্সি হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। গ্যাং কালচার ও কিশোর অপরাধ দমনে র‌্যাবের সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। ২০১৭ সাল হতে অদ্যাবধি ৭ শতাধিক কিশোর অপরাধীকে গ্রেফতার করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। র‌্যাব ফোর্সেস বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে কিশোর অপরাধ প্রবণতা রোধকল্পে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়াও, বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের কিশোরঅপরাধ প্রবণতা প্রতিরোধ ও তার কুফল সম্পর্কে নিয়মিত প্রেষণা প্রদান করছে। এই বাহিনীটির নিয়মিত প্রচার প্রচারণার পাশাপাশি কিশোর অপরাধমুক্ত সমাজ গঠন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারি ও বিভিন্ন অভিযান কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

আজকের কিশোররাই আগামীর উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশের কর্ণধার। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে দেশকে গড়ে তুলতে হলে শিশু-কিশোরদেরকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে কাজে লাগাতে হবে।

লেখক: লেফটেন্যান্ট কর্নেল, বিএসপি, পিএসসি

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন