শুক্রবার, ০২ জুন ২০২৩, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সোনালি যুগের রুপালি বাজেট

আপডেট : ২২ মে ২০২২, ০৬:৫২

আক্ষরিক অর্থেই বিগত দশককে বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের উন্নয়নের যত উল্লেখযোগ্য মাইলস্টোন ছিল তার সবই এ সময়ে অর্জিত হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বেশির ভাগই নির্ধারিত সময়ে অর্জন করার ফলে ডজনের বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়। বাংলাদেশ ২০১৫ সালে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয় এবং স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার শর্ত দুইবার পূরণ করে (২০১৮, ২০২১)। বাংলাদেশের উন্নয়নের যত মাইলফলক ও অর্জন, তা এই দশকে সম্পন্ন হয়েছে। এর মূলে রয়েছে সরকারের উন্নয়ন দর্শন তথা উন্নয়নের জন্য নয়া জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ। বাংলাদেশের সরকারের উন্নয়ন দর্শন ও বাস্তবায়ন প্রতিফলিত হয় ২০২১ রূপকল্পভিত্তিক দুটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে।

গত দশকের আগের (২০০২ সালের আগে) অধিকাংশ পরিকল্পনা ছিল মূলত বিনিয়োগ পরিকল্পনা। মূলত আশি-নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধ এবং এই শতকের প্রথম দশকের উন্নয়ন পরিকল্পনা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পরিবর্তে ওয়াশিংটন কনসেনসাস কিংবা পিআরএসপি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এসব ওয়াশিংটন মতৈক্যও ছিল মূলত কতগুলো নীতির সমষ্টি, যেমন—বাজেট ঘাটতি কমানো, অর্থনৈতিক রিটার্নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা বাদ দেওয়া, আর্থিক খাত উদারীকরণ, কর পদ্ধতির সংস্কার, বাণিজ্য বিধিনিষেধ কমানো, বৈদেশিক বিনিয়োগের বাধা দূর করা, ব্যক্তিসম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা।

এসব নীতি আফ্রিকার বিভিন্ন দরিদ্র দেশ গ্রহণ করেছিল অথচ আমাদের পাশের দেশ ভারত, নেপাল গ্রহণ করেনি। এসব নীতি সমষ্টি দেশজ বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপটকে বিবেচনা করে না এবং অন্তভু‌র্ক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নকে উত্সাহিত করেনি। যার ফলে বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ আফ্রিকার দেশগুলো কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভ করতে পারেনি। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত সময়ে একটি অন্তর্বর্র্তীকালীন ও দুটি পূর্ণাঙ্গ দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্রে সরকারের তেমন কোনো নীতি মালিকানা ছিল না। এগুলো মূলত বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপিয়ে দেওয়া কৌশল, যাতে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল না। তাছাড়া এটি এমন সময়ে করা হয় যে সময়ে বৈশ্বিক মহামন্দার (২০০৭-০৯) কারণে ওয়াশিংটন কনসেনসাস ব্যর্থ বলে প্রতীয়মান হয়। এই সময়ে বাংলাদেশের সাফল্যকে ক্ষণস্থায়ী ও আকস্মিক ধরা হতো। শুরুতে প্রতিকূল পরিস্হিতি, দুর্নীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও সমজাতীয় আয়ের দেশের তুলনায় একবিংশ শতকের প্রথম দশকের শেষের দিক থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক অগ্রগতি অনেকের কাছে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ বা ‘উন্নয়ন গোলকধাঁধা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে গত এক যুগে সামাজিক অগ্রগতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমসাময়িক দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বের উন্নয়ন বিশ্লেষকদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। সর্বশেষ জাতিসংঘ অনুমোদিত সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলু্যশন নেটওয়ার্ক কর্তৃক বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অগ্রগতি পদক প্রদান বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের অন্যতম নিদর্শন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যাহতি পরেই পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি ধনী ছিল অথচ বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন পাকিস্তানের চেয়ে ৫৬ শতাংশ বেশি। এমনকি গত দুই বছর ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে বেশি ছিল। সামাজিক সূচকে অনেক আগেই ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলা বাংলাদেশ এখন মাথাপিছু আয়েও তাদের পেছনে ফেলেছে।

একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে বাংলাদেশের জনগণের দারিদ্র্য নিরসন ও কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রেখেছে পরিকল্পনায় গুণগত পরিবর্তন। কৃষিপ্রধান অর্থনীতি থেকে এখন শিল্প ও সেবা খাতের দিকে দেশ অগ্রসর হচ্ছে। তাছাড়া তৃণমূল জনগণের উদ্যোক্তা মনোভাব ও প্রতিকূল পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নকে বহুলাংশে ত্বরান্বিত করেছে। গত দশকে সরকারের সুপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উত্থান ঘটেছে। এক্ষেত্রে স্বাধীনতার সময়ের উন্নয়ন দর্শনকে পুনর্জীবিত করা হয়েছে। এই পরিকল্পনাগুলোর মধ্য দিয়ে ‘এক নয়া জাতীয় পরিকল্পনা যুগের’ সূচনা হয়। এর বৈশিষ্ট্য হলো দেশজ উদ্ভূত, জাতীয় সত্তাতাড়িত, জাতীয় নেতৃত্বের সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রণীত। রূপকল্পভিত্তিক নয়া জাতীয় পরিকল্পনার ফলেই বাংলাদেশ নয়া অর্থনৈতিক উন্নয়নের যুগে প্রবেশ করে। এর ফলে গত দশকে প্রবৃদ্ধির বিরামহীন দ্রুত উল্লম্ফন ঘটে। প্রবৃদ্ধির বিচারে গত দশকে বাংলাদেশের চেয়ে একমাত্র চীনই এগিয়ে ছিল।

তবে কোভিড-১৯ বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে এক মারাত্মক অভিঘাত নিয়ে এসেছে যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রথম দুই বছর কিছুটা হোঁচট খেয়েছে। এটা সত্য যে, কোভিডকালীন প্রথম বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি (৩.৪৫ শতাংশ) বিশ্বে শীর্ষ তিনটি দেশের মধ্যে ছিল, যেখানে অধিকাংশ দেশের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি এবং জীবন ও জীবিকাকে কেন্দ্র তার সময়োপযোগী হস্তক্ষেপের ফলে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। তাছাড়া গত ১৩ বছরে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.৩ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি ৭.২৫ শতাংশ, মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার, যা প্রকাশ করে যে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সরকার যথাসময়ে ২৮টি অর্থনৈতিক খাতের জন্য ২১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের (জিডিপির ৫.৩ শতাংশ) বিভিন্ন উদ্দীপনা প্যাকেজ এবং যথাযথ নীতিকৌশল গ্রহণ করার ফলে এটি সম্ভব হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কভারেজসহ সামাজিক নিরাপত্তার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, বর্তমান বছরের জন্য বরাদ্দ প্রায় ১২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (জিডিপির ৩ শতাংশ এবং বাজেটের ১৭.৮ শতাংশ)। সম্প্রতি কোভিড পুনরুদ্ধার সূচকে (নিক্কেই ইনস্টিটিউট, জাপান) বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ও বিশ্বে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। সরকার প্রণোদনা, নগদ সহায়তা, সম্প্রসারিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণের ফলে কোভিডের সময়ে দেশের দারিদ্র্য পরিস্হিতি অনুকূলে ছিল।

সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোলে পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা টালমাটাল হয়ে পড়েছে। একদিকে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্য দিকে আমাদের আমদানি খরচও একই সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার খাদ্য মূল্যসূচক গত মার্চে ১৯৯০ সালের পর থেকে রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মূল কারণ খাদ্যশস্য ও ভোজ্য তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে—যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে। বাংলাদেশেও ইতিমধ্যে এর অভিঘাত পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর হিসাবে ও মার্চে মূল্যস্ফীতি ৬.২২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই মূল্যস্ফীতির সবটাই বৈশ্বিক প্রভাবিত। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সর্বত্র পড়তে পারে। তাছাড়া যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। সে কারণে আগামী বাজেটের জন্য সরকার সম্প্রসারণমূলক নীতি থেকে কিছুটা সরে আসবে। ইতিমধ্যে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেসব প্রকল্প কম গুরুত্বপূর্ণ বা উত্পাদনমুখী নয়, সেগুলো এখন অনুমোদন করবে না। সরকার এখন খুব সতর্কভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রকল্প অনুমোদন করছে। এবারের বাজেটে তাই প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা হবে। সোনালি যুগে খুব বড় আকারের বাজেট না করে মাঝারি ব্যয়ের রুপালি বাজেটের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে গুণমান বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। তবে এই সময়েও গত এপ্রিল পর্যন্ত রাজস্ব আয় ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি, গত মার্চ পর্যন্ত ৪৬ শতাংশ রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, ৫৮ শতাংশ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির বিপরীতে স্বস্তিদায়ক। চলতি অ্যাকাউন্টে ঘাটতি আমাদের দেশজ আয়ের ১ শতাংশ, যা জিডিপির ৪ শতাংশের নিচে থাকলে স্বস্তিদায়ক জোনে আছে মনে করা হয়।

এই মে মাসের মধ্য পর্যন্ত সামষ্টিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকসমূহ এখনো আশঙ্কামূলক মনে করা যাবে না। এই পর্যন্ত আমরা ভালোভাবেই সামলে নিচ্ছি এবং সতর্কমূলক বাজেট প্রণয়নে এগিয়ে যাচ্ছি। সোনালি যুগের পূর্ণ সম্ভাবনার সোনালি বাজেট না বলে বলছি দ্বিতীয় সর্বোত্তম (সেকেন্ড বেস্ট) রুপালি বাজেট এ কারণে যে, যদি আকস্মিক কোভিড-১৯ আঘাত আমাদেরও গ্রাস না করত, তাহলে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে পূর্ণ বাজেট আকার হতো ৭ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকার, যা এখন হচ্ছে ৬ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা, মোট উন্নয়ন বাজেট ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার পরিবর্তে ২ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এটা কমিয়ে ধরার মূল কারণ কোভিড জনিত অপ্রত্যাশিত ব্যয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ দিক বিশেষ করে বিতরণ ও ব্যবস্থাপনায় যাতে কোনো ঘাটতি না থাকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে মজুতদারি না থাকে সে ব্যাপারে সরকার নিয়মিতভাবে তদারকি করছে। তবে আমাদের সামনে যাতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক গোলযোগ বা ধর্মঘট না থাকে সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে, কেননা তাতে বাজারে পণ্য চলাচলব্যবস্থা কঠিন হয়ে যাবে, ফলে তা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি এবারের বাজেটে করজাল বৃদ্ধিসহ কর আদায়ে অটোমেশন বৃদ্ধির দিকে জোর দিতে হবে, যাতে কর জিডিপির হার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে।

রূপকল্প ২০৪১ অনুযায়ী প্রণীত অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দে প্রাধান্য থাকছে মানবসম্পদ উন্নয়ন, সে কারণে শিক্ষা ও স্বাস্হ্য খাতে ব্যয়বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে, সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ থাকবে দরিদ্রদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয়বৃদ্ধি, প্রাধান্য থাকবে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে এবং পরিবেশ উন্নয়নে বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনার বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে ব্যয়বৃদ্ধি। এটি হতে যাচ্ছে সময়োপযোগী বাজেট।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন