শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অ্যান্টিবোয়োটিকের কার্যকারিতা হারাইতেছে

আপডেট : ২২ মে ২০২২, ০৭:১৪

‘অ্যান্টিবায়োটিক’— অণুজীববিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের ‘বৈপ্লবিক আবিষ্কার’ ১৯২৭ সাল হইতে রোগমুক্তিতে ‘ত্রাতা’ হইয়া অবদান রাখিয়া চলিতেছে। আবিষ্কারের সময়ই ফ্লেমিংয়ের ঘোষিত ‘এই অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে কোটি কোটি মানুষ বেঁচে যাবে’— কথাটি মানবজাতি স্মরণে রাখিলেও ‘তুচ্ছ কারণে এগুলো আর কাজ করবে না, কোটি কোটি লোক মারা যাবে আবার’

সতর্কবার্তাটি বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছে। মানবকল্যাণে ‘আশীর্বাদ’ হইয়া আবিভূ‌র্ত মহৎ সৃষ্টি অ্যান্টিবায়োটিককে ‘অভিশাপ’ হিসাবে দাঁড় করাইবার আয়োজন চলিতেছে। ‘অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সতর্ক হোন’ উচ্চারণকে বারংবার উপেক্ষার নিদারুণ চিত্র আজ সর্বত্র দৃশ্যমান হইয়া উঠিয়াছে। দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ ব্যতিরেকেই অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে বাড়াবাড়ি চলিতেছে। একবিংশ শতাব্দীর সচেতনতার বিশ্বে এই পর্যায়ে আসিয়াও তাই ‘রোগীর চেয়ে ডাক্তার বেশি’ প্রবাদটির তকমা ঘুচানো যাইতেছে না কোনোক্রমেই।

ঔষধ কোম্পানিগুলির লাগামহীন উত্পাদনের সুযোগ লইয়া ফার্মেসি মালিকরাও পাল্লা দিয়া ময়দানে নামিয়াছেন। লাইসেন্সের নীতিমালা অনুসরণ না করিয়া অথবা ফর্মেসিতে নিয়োগের সুযোগ পাইয়া ‘অ্যান্টিবায়োটিক গলধঃকরণ’কে রুটিন করিয়া তুলিতেছেন। ব্যবস্থাপত্র ব্যতিরেকেই অ্যান্টিবায়োটিক উঁচাইয়া ধরা হইতেছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলি সতর্ক-পরিমিত ব্যবহারের সুযোগ লইয়া অ্যান্টিবায়োটিকের সুফল পাইতেছেন জানিবার পরও এই জনপদের ‘অতি উত্সাহী’ মানুষের মধ্যে সচেতনতার বালাই নাই। ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়িতে অ্যান্টিবায়োটিকের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতে সতর্ক করা হইতেছে শুরু হইতেই। ‘মেডিসিনের বাইবেল’ খ্যাত ডেভিডস এই উপমহাদেশের মানুষকে সতর্ক করিলেও কর্ণপাত করিতেছেন কেউ। ফলে অপেক্ষাকৃত ছোট রোগ হইতে আরোগ্য লাভ করিতে যাইয়া বড় ব্যাধিকে আলিঙ্গন করা হইতেছে।

জানা গিয়াছে, দেশে ৬৭ শতাংশ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করিতেছে না। কী ভয়াবহ কথা! ঔষধ প্রশাসনের পাশাপাশি ঔষধ কোম্পানিগুলিরও দায় এড়াইয়া যাইবার সুযোগ কম। তাহারা শুধু উত্পাদন-বিপণনেই নিবিষ্ট থাকিতেছেন, অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষতিকর দিকগুলি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করিবার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করিতেছেন না। মোড়কের গায়ে সতর্কতামূলক ‘লাল চিহ্ন’ যুক্ত করা গেলেও অন্ততপক্ষে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যাইত। দুর্ভাগ্যজনক সত্য, এরূপ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করার আলামত দৃষ্টিগোচর হয় নাই। মেডিসিন কোম্পানিগুলি এ জাতীয় পন্থার ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে জনগণকে সতর্ক করিবার মহৎ কার্য করিয়া বাহবা পাইতে পারে। ঔষধ প্রশাসনের দায় রহিয়াছে এই ধরনের কিছু নিয়মকানুন বাঁধিয়া দেওয়ার। এই সমস্ত বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা বাড়াইতে হইবে। কর্তাব্যক্তিরা অ্যান্টিবায়োটিকের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিতে পর্যাপ্ত উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থ হইয়াছেন বলিলে কি অযুক্তি হইবে?

মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করিতে ক্রমাগত মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতেছে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার— এই ব্যাপারে ভাবিবার সময় অতিক্রান্ত হইয়াছে বহু পূর্বেই। অতিব্যবহারের ফলে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারাইতেছে দ্রত গতিতে, যার আশু ফলাফল ‘অশনিসঙ্কেত’ হইয়া সম্মুখে দাঁড়াইবে। বর্তমান সময়ে অ্যান্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাবের শিরোনাম বাড়িতেছে। সময়ের আবর্তে ব্যাকটেরিয়ার অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধি পাইয়াছে; যার প্রভাব এড়াইবার সুযোগ নাই। এই সমস্ত ক্ষেত্রে একটিমাত্র উপায়ই আছে— অ্যান্টিবায়োটিকের পরিমিত ব্যবহার। রেজিস্ট্রার্ড চিকিত্সকের পরামর্শ ব্যতিরেকে কোনোক্রমেই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা উচিত হইবে না। প্রয়োজন না পড়িলে অ্যান্টিবায়োটিক এড়াইয়া যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হইবে। ‘জনগণ সচেতন না হইলে কী করার আছে’— এই খোঁড়া যুক্তির বদলে কী করিয়া এই প্রবণতার যবনিকাপাত ঘটানো যায়, ভাবিতে হইবে তাহা লইয়াই।

‘অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনা দিবস’ পালনের অনুষ্ঠানে সচেতনতার বুলি ফুটাইয়া সাধারণ সর্দি-জ্বরে নিজেই অ্যান্টিবায়োটিক গিলিবার বদ অভ্যাস ছাড়িতে হইবে। করোনা অতিমারির ধকল সহ্য করিবার পর শরীর অ্যান্টিবায়োটিকের ‘জোর ধাক্কা’ সামলাইবার পরিস্থিতিতে আছে কি না— এই বাস্তবতা লইয়া না ভাবিলে খেসারত দিতে হইতে পারে। ‘মানুষ অভ্যাসের দাস’—যুক্তিকে আদর্শ মানিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার কমাইতে পারিলেই ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’ বলিয়া গর্ব করা যাইবে।

ইত্তেফাক/এসজেড