বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অন্য দুর্যোগের চেয়ে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং বহুমাত্রিক ক্ষতি করে। বন্যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় এক বাধা এবং মানুষের আর্থিক ও মানসিক অপূরণীয় ক্ষতি করে। তার পরও বন্যার সঙ্গে লড়াই করে এ দেশের মানুষ বেঁচে আছে যুগ যুগ ধরে। এ দেশে ত্রিকোণী জালের মতো ছোট-বড় নদী, খালবিল থাকলেও অনেকগুলো ভরাট হয়ে অস্তিত্ববিপন্ন। উজানের দেশ ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে পলিমাটি এসে দেশের নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে অনেক নদী মরে যায় কিংবা মধ্যখানে বড় চর জেগে পানিপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি করছে। একসময় পাহাড়ি ঢল ও প্রচুর বৃষ্টিপাত হলেও নদীর গভীরতা থাকায় বন্যা হয়নি। কিন্তু বর্তমানে আগের চেয়ে কম বৃষ্টি এবং সাধারণ পাহাড়ি ঢলের পানিতে বড় রকমের বন্যার সৃষ্টি হয়। মানবসৃষ্ট কারণে বন্যা হওয়ার অন্যতম একটি কারণ। যুগ যুগ ধরে নদী অযন্ত্রে, অবহেলায় ডাস্টবিনের মতো পড়ে আছে। নদীসহ তীর দখল করে বাসাবাড়ি, দোকান তৈরি করে নদীর স্বাভাবিক গতিতে বাধা ও তীরের বেড়িবাঁধ ধ্বংসের কারণে বন্যার পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। অপরিকল্পিতভাবে ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ এবং নদী দখল বন্যার আরেকটি অন্যতম কারণ। ভরাটকৃত নদীখনন ও খননকৃত মাটি দ্বারা নদীর তীর সংরক্ষণ এবং সৃষ্ট পানি ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে দেশকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
বন্যায় বর্তমানে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় এখন লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বিদু্যতের কয়েকটি সাবস্টেশন পানিতে ডুবে যাওয়ায় সিলেট কয়েক দিন অন্ধকার ও ভূতুরে নগরী ছিল। গত ১৬ মে থেকে তিন-চার দিন রান্নাবান্না, গোসল দূরে থাক, হাতমুখ ধৌত করা ছিল মুশকিল। সিলেট শহরের প্রায় ৮০ ভাগ বাসাবাড়ি হাঁটুপানির নিচে। হযরত শাহ জালাল (র.) মাজার মসজিদের নিচতলায় পানি। শহরের তালতলা, উপশহর, বাবনা রোডসহ অনেক স্থানে গ্যাসের পাইপলাইনে ছিদ্র দিয়ে বুদ্বুদ করে গ্যাস বের হচ্ছে। এতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
গত ১৮ মে বুধবার সিলেট নগরীর বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এমপি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণমন্ত্রী ড. এনামুল হক এমপি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘আগামী বর্ষার আগেই সুরমা ও কুশিয়ারা নদী খনন করা হবে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে খুবই আন্তরিক’। দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলো খনন ও তীর সংরক্ষণের বিষয়ে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকায় ইতিপূর্বে দুটি নিবন্ধন প্রকাশিত হয়েছিল। এ বন্যায় নদী খননের প্রয়োজনীয়তার কথা এখন সিলেটের মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হচ্ছে।
আসামের নাগা, মণিপুর অঞ্চল থেকে উত্পত্তি হয়ে আসা সুরমা নদী বাংলাদেশের সীমান্েত প্রবেশ করে সিলেট শহরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ছাতক-সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনায় গিয়ে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়। এই সুরমা নদীতে জায়নামাজ বিছিয়ে নদী পার হয়েছিলেন হযরত শাহজালাল (র.) ও তার সফরসঙ্গীরা। সেই সিলেট শহর এখন পানির নিচে। গত সাত বছরে সিলেট শহরের ছড়া, খাল খনন, দখল উদ্ধার, গার্ডওয়াল নির্মাণ, পুরোনো ড্রেন ভেঙে নতুন ড্রেন নির্মাণে ২৪৫ কোটি টাকা খরচ করেও শহরবাসীর কোনো উপকারে আসেনি। এসব অপরিকল্পিত উন্নয়ন পানি নিষ্কাশনে বড় এক বাধা। খাল, ছড়ার ওপর বাসাবাড়ি, দোকান তৈরি করে খালের প্রস্হ কমিয়ে আনা এবং পলিথিন, প্লাস্টিক, ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখার কারণে খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি সময়মতো নামতে পারে না। বরং নদীর পানি উপচে শহরে ঢুকে বন্যা দেখা দেয়। এমন অপরিকল্পিত উন্নয়ন এখন শহরবাসীর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।
সিলেট বিভাগে ছোট-বড় ৮৭টি নদী রয়েছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জে ২৬টি, হবিগঞ্জে ২৮টি এবং সিলেটে ৩৩টি নদী রয়েছে। এসবের অনেকগুলো নদী অস্তিত্ববিলীন। হাসপাতাল-ক্লিনিকের বর্জ্য, পলিথিন-প্লাস্টিক ফেলে ভরাট করা হচ্ছে নদীগুলো। দখলদূষণ অপরিকল্পিতভাবে নিচু ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণের কারণে নদী ভরাট হয়ে তীরের সমান হয়ে গেছে। এতে পাহাড়ি ঢলের পানি ধারণ করা দূরে থাক, সাধারণ বৃষ্টির পানিতেও অকাল বন্যা দেখা দেয়। যেসব নদীর তীরে হাটবাজার, শহর, বন্দর গড়ে উঠেছে, সেখানে নদীর তীর একবারে নিচু। ফলে, এসব নিচু এলাকা দিয়ে সহজে বন্যার পানি ঢুকতে পারে। ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণে উচ্চতা ও প্রস্হ কম, গার্ডওয়াল না দিয়ে মাটি ভরাট করে জোড়াতালি দিয়ে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করায় বানের পানিতে এসব ভেসে যায়। বন্যায় সিলেট-সুনামগঞ্জের সব কটি উপজেলার কাঁচাপাকা রাস্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডুবে গেছে। অনেক স্থানে পানির তোরে ব্রিজ, কালভার্ট দুমড়েমুচড়ে ভেসে গেছে। চোখে না দেখা পর্যন্ত বন্যার এমন ভয়াবহতা কেউ বিশ্বাস করতে পারবেন না। এ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি অঙ্কে হিসাব করা বড়ই কঠিন। বৈশাখ মাসে সুনামগঞ্জের হাওরের বেড়িবাঁধ ভেঙে শতকোটি টাকার ইরি, বোরো ধান নষ্ট হয়ে যায়। হাওরে বেড়িবাঁধ নির্মাণে অনিয়ম, দুর্নীতি এ ক্ষতির মূল কারণ। বর্তমানে বন্যাকবলিত এলাকায় চরমভাবে খাদ্য, জ্বালানি ও বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট রয়েছে। সুনামগঞ্জের ঘরে ঘরে পানি এবং রোদের অভাবে লাখ লাখ টাকার ধান শুকানো যাচ্ছে না। মাছ, হাঁস, মোরগ, গরু-ছাগলের খামার ডুবে যাওয়ায় ফার্মের মালিকদের কান্নায় এ অঞ্চলের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে।
সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দাবাধরন মাটি গ্রামের বাসিন্দা সরকারি চাকরীজীবী মো. আব্দুল বারি বন্যার খবর জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি জানান, গত ১৩ মে শুক্রবার সিলেট শহরে একটি সভায় যোগদান করার কথা ছিল। বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় ঘুমিয়ে পড়লে ১১টার মধ্যে তার ঘর ডুবে যায়। মাত্র দুই তিন ঘণ্টার মধ্যে পাহাড়ি ঢলে সারি, পিয়াইন, গোয়াইন, চেঙ্গেরখাল, সুরমা, কুশিয়ারার পানি বৃদ্ধি পেয়ে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। তিনি জানান, জকিগঞ্জের আমলসীদ ত্রিমোহনায় বরাক, সুরমা, কুশিয়ারা নদীর মোহনার বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বন্যার ভয়াবহতা বৃদ্ধি পায়। গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা ও বিশ্বনাথ উপজেলার প্রতিটি ঘরে ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। মানুষ বাঁশের মাচাং, দুতলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। অনেকের গবাদি পশুসহ সহায়-সম্বল পানিতে ভেসে গেছে।
বিভাগীয় শহর সিলেট ও সুনামগঞ্জ সুরমা, মৌলভীবাজার মনু নদ এবং হবিগঞ্জ জেলা সদর খোয়াই নদীর তীরে অবস্হিত। সুরমা, কুশিয়ারা, কালনী, মনু, খোয়াই, যাদুকাটা, বরাক, কলকলিয়া, নলজুড়, ধলেশ্বরী, বাসিয়া, খাজাঞ্চীসহ এই অঞ্চলের নদী ও খালের ওপর অপরিকল্পতভাবে উচ্চতা ও প্রস্হ কম সেতু নির্মাণের কারণে বন্যার পানি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। এসব ব্রিজ, কালভার্ট বা সেতুর নিচ দিয়ে নৌকা বা জলযান যাতায়াত করতে পারে না। একদিকে নদী ভরাট, অন্যদিকে নিচু সেতু এতে পানির গতি স্বাভাবিকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এমন ব্রিজ, কালভার্ট পানির তোরে ভেসে গেছে।
পানি সম্পদ, এই পানি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে হয়, আপদ বা বিপদ। জীবনে-মরণে, দাফন-কাফনে, পুত-পবিত্রতায় পানি। কৃষি-শিল্প বিকাশে ও বিদুত্ উত্পাদনেও পানি। পানি ছাড়া জীবন চলে না। পানির বিকল্প এ পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়নি। পানির সদ্ব্যবহার বা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পানিকে শ্রেষ্ঠ সম্পদে পরিণত করা যায়। পৃথিবীর অনেক দেশ নদীখনন, তীর সংরক্ষণ করে পানি সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অনেক সমৃদ্ধি ও সাফল্য অর্জন করেছে। এবারের বন্যায় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সব শ্রেণি পেশার মানুষ নদী খনন ও তীর সংরক্ষণের গুরুত্ব অনুভব করতে পেরেছেন। বন্যায় বিশুদ্ধ পানির অভাবে হাতমুখ ধৌত করা, গোসল করা, রান্নাবান্নার কাজ ছিল বন্ধ।
নদী, রাষ্ট্র বা সরকারের মালিকানাধীন। কিন্তু নদীর সুফল ভোগ করবে এ দেশের নাগরিক। তাই নদীকে বাঁচাতে ১৯৫৬ সালের এসএ রেকর্ড মোতাবেক সরেজমিনে জরিপ করে সব নদনদীর সীমানা চিহ্নিত করে পিলার নির্মাণ, ভরাটকৃত নদীর তলদেশ ও তীর জরিপ করে প্রকল্প গ্রহণ আবশ্যক। কাল্পনিক প্রকল্প গ্রহণ করে নদীখনন ও তীর সংরক্ষণ হলে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় করা মোটেই কাম্য নয়। নদী জরিপ, খনন ও তীর সংরক্ষণে সেনাবাহিনীর বিজ্ঞ চৌকশ লোকদের যুক্ত করা হলে রাষ্ট্রে পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব এবং এ দেশকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।
লেখক: কলামিস্ট ও সমাজ বিশ্লেষক