বুধবার, ০৭ জুন ২০২৩, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

অশ্রুসিক্ত স্মৃতি তর্পণ 

আপডেট : ২৪ মে ২০২২, ০৮:৩২

পরম সৌভাগ্য আমার, জন্মেছিলাম ১৯ শতকে, রবীন্দ্রনাথের বাংলায়, জীবনানন্দ দাশের বাংলায়, মুজিবের বাংলায়। সান্নিধ্য পেয়েছি এক অসামান্য প্রতিভার। স্নেহ-প্রীতিঋদ্ধ হয়েছি অনেক গুণীজনের।

আমার বয়স তখন ১২। আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। গাফ্ফার ভাই ঢাকা কলেজে পড়েন দ্বাদশ শ্রেণিতে। একুশের আকাশ-বাতাস টিয়ার গ্যাস গুলি বরকত সালামের রক্ত ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়া মগজ আমাদের আচ্ছন্ন করেছিল।

গাফ্ফার চৌধুরীর অমর সৃজন, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গান ঢাকা কলেজে গাওয়া হলো আব্দুল লতিফের দেওয়া সুরে। গাফ্ফার ভাইয়ের ঘাড়ে নামল বহিষ্কারের খড়্গ। তখন নাম শুনেছি তার, কিন্তু দেখিনি। দেখা হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫।

আমি দেওয়াল পত্রিকা বের করলাম। নামটা বিদঘুটে, ‘ঠুস ঠাস’। হুলস্থুল হলো। বেআইনি কাজ বলে জেলার অগ্নিশর্মা হয়ে নিজে হাতে ছিঁড়ে ফেললেন। পরের সংখ্যায় শীর্ষ শিরোনাম গাফ্ফার ভাই বলে দিলেন, ‘ঠুস ঠাস চির অব্যাহত থাকবে’। সেবারও জেলার এসে ছিঁড়ে ফেললেন। তৃতীয় সংখ্যায় ছোট্ট করে কড়া একটা সম্পাদকীয় লিখে দিলেন গাফ্ফার ভাই, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’। জেল কর্তৃপক্ষের রক্তচোখ ও রোষ থেকে বাঁচালেন সহবন্দি জিল্লুর রহমান, শামসুজ্জোহা, এস এ বারি এটি ও আবুল মাল মুহিতসহ জ্যেষ্ঠরা।

দেওয়াল পত্রিকা লিখে আমার হাতেখড়ি হলো। আমিও একজন খুদে সাংবাদিক হয়ে গেলাম। শতাধিক সহবন্দি। আমি সর্বকনিষ্ঠ। সবাই কাছে ডাকলেন। প্রদেশের সব কটা ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতা থেকে পাতি নেতা। ঢাবি সব হলো এবং সব কটি কলেজের ভিপি জিএস। চিরুনি তল্লাশি দিয়ে ছেঁকে আনা হয়েছিল। আমাকে এনেছিল ‘আমি কি ভুলিতে পারি...’ গান গাওয়া রাজপথের আইন ভাঙা ভোরের মিছিল থেকে। সবার কাছেই আদর-আপ্যায়ন পেলাম। তারপর আরো অনেক কাণ্ড। গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হলো। পাহাড়ের পাশে নুড়িপাথর যেমন। তখনই কয়েকটা বই বেরিয়েছে তার।

আমি ক্লাস টেনে পড়ি, গাফ্ফার ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ২য় বর্ষ। এক মাস পর আমরা মুক্তি পেলাম। গাফ্ফার ভাই থাকতেন এফএইচ হলের পশ্চিম দিকের একতলায়। রুম নম্বর ১২। অনেকবার দেখা হয়েছে। তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। আবার দেখা হলো পিআইএর বোয়িং বিমানে। ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৩, বোয়িং বিমানের উদ্বোধনী ফ্লাইটে লাহোর গেলাম পিআইএর মেহমান হয়ে।

গাফ্ফার ভাই স্বনামধন্য সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট। অসামান্য গীতিকার ও কবি। আমি ইত্তেফাক কাগজের তুচ্ছ সাব-এডিটর। বিমানে পাশাপাশি বসে কথা বলতে বলতে দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেল। তখনো ইন্টার কন্টিনেন্টালের মতো কোনো পাঁচতারা হোটেল হয়নি। লাহোরের সবচেয়ে বিলাসবহুল নামিদামি পার্ক লাক্সারি হোটেলে তিন দিনের রাজকীয় জীবন ছিল স্বপ্নের মতো, মধুরেণু, রঙিন। গাফ্ফার ভাই বললেন, ঐতিহাসিক শহর, এখানে দেখার আছে অনেক কিছু, চলো আমরা কয়েক দিন আরো থেকে তার পরে বাড়ি ফিরি। ঢাকা ফেরার দুখানা টিকিট হাতে দিয়ে পিআইএ আমাদের আলবিদা জানাল। আমরা উঠলাম গিয়ে পেইন্টার রউফের বাসায়। গাফ্ফার ভাইয়ের ঘনিষ্ঠজন, আমার একান্তই পরিচিত।

কয় দিন ধরে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো সব ঘুরে ঘুরে দেখলাম। একদিন দুপুরে সিভিল সার্ভিস একাডমিতে লাঞ্চ খেলাম অনেকের সঙ্গে। গাফ্ফার ভাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বন্ধুদের আমন্ত্রণে ভূরিভোজ। অন্য দিনের খাদ্য তালিকায় ছিল দৈর্ঘ্য প্রস্হে দেড় ফুট গোলাকার মেগা চাপাতি ও ফ্রি দই-পেঁয়াজ। দাম দুই আনা। বাড়তি চার আনা খরচ করলে এক পিরিচ দুম্বার মাংস পাওয়া যেত। পকেটে ছুচো ডাকতে শুরু করেছে। দুজনই তাই কৃচ্ছ্রসাধনে প্রবৃত্ত হলাম। দুই বেলা রুটি-পেঁয়াজ, কেবল রাতেই মাংস সংযোগে প্রাণ রক্ষা পেল।

ঢাকা থেকে যখন বের হলাম তখন ভাবিনি যে গোটা লাহোর চষে হাজার বছরের ইতিহাসের আনাচকানাচে হেঁটে বেড়াতে পারব। গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে, সেটাও ভাবিনি। গাফ্ফার ভাইয়ের হাত ধরতে না পারলে সফর সার্থক হতো না। গাফ্ফার চৌধুরী রাজনীতিতে কখনো সক্রিয় হননি। মতাদর্শে ছিলেন সে সময় রেডিকাল। আরএসপি ভক্ত ছিলেন। তার অন্তরঙ্গ সংগ্রামী চেতনাই তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল এমন অনন্য গান রচনায়, যা আবেগে ভাসিয়ে দিল বিশ্ব বাঙালিকে।

’৫৪ সালের নীরব ব্যালট বিপ্লবের নেতা ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল সবারই। কিন্তু ফজলুল হক যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দিলেন ইসলাম বাঁচাবার কথা বলে, মনের ভেতর পাকিস্তান বাঁচিয়ে বড় পিঁড়ি পাওয়ার খায়েশ নিয়ে। আঁতাঁত করলেন ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হলেন। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। গণতন্ত্রের মানসপুত্র খ্যাত অখণ্ড বাংলার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অতি ডানে কাত হয়ে ও মওলানা ভাসানী অতিবাম হয়ে আওয়ামী লীগ ভেঙে দিলেন ১৯৫৭ সালে। তা না হলে সামরিক শাসনও হয়তো হামলে পড়ত না। ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো। অনেক ব্যাপারে ভিন্নমত থাকলেও এ ব্যাপারে আমাদের ঐকমত্য ছিল। ন্যাপ গঠন করে বামপম্হিরা কল্পিত ও কথিত কোনো লক্ষ্যেই পৌঁছাতে পারেনি, বরং টুকরো টুকরো হয়ে আত্মহননের পথে এগিয়েছে। এ ব্যাপারেও আমরা সহমত ছিলাম। ন্যাপ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন সকল গণসংগ্রামের পৃষ্ঠপোষক পাঞ্জাবের মার্কসবাদী ধনকুবের মিঞা ইফতেখার উদ্দিন ঢাকার রাজপথে লাঞ্ছিত হলেন ৪ জুলাই ’৫৭ ন্যাপ সম্মেলনে গিয়ে। পাঞ্জাবের কৃষক আন্দোলনের কিংবদন্িত মেজর ইসহাক ও তুখোড় আইনজীবী মিঞা মাহমুদুল হকও উপস্হিত ছিলেন সীমান্ত গান্ধী খান আব্দুল গ্ফফার খান ও পশ্চিমের অন্য প্রগতিশীল নেতাদের সঙ্গে। রূপমহল হলে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনে।

মিঞা ইফতেখার উদ্দীন ‘আমি কি ভুলিতে পারি, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা ও পত্রিকা সম্পাদক গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে মতবিনিময় করতে আগ্রহী হলেন।

’৪৮ থেকে বহু ত্যাগ-সাধনায় গড়ে ওঠা প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যমঞ্চ আওয়ামী লীগ ভেঙে গেল তাসের ঘরে মতো। সোহরাওয়ার্দী গদি হারালেন ১৭ অক্টোবর ’৫৭। সামরিক শাসনের খড়্গ নামল ৭ অক্টোবর ১৯৫৮। ‘আমও গেল ছালাও গেল’।

গাফ্ফার ভাই বললেন, এত দূর আসলাম যখন, চলো, পেশোয়ারটা দেখে আসি। রাওয়ালপিন্ডিও দেখা হয়ে যাবে একই যাত্রায়। আমিও রাজি।

অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে গেল লাহোর রেল স্টেশনে। আমরা রেল কারে করে পিন্ডি যাব। টিকিট কাউন্টারে দাঁড়ালাম। আমরা চাইলাম টিকিট। কিন্তু টিকিট না দিয়ে দুজন কর্মী বেরিয়ে এসে আমাদের আলিঙ্গন করলেন। তারপর ভেতরে নিয়ে বসালেন। চা কেক বিস্কুট আনিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। তাদেরকে আমরা বাঙালি বলে চিনিনি। কিন্তু তারা ঠিকই শনাক্ত করেছেন। অবিশ্বাস্য ঘটনা। দ্রুতগামী রেলকারে আমাদের দুজনেরই প্রথম সফর। নতুন যাত্রাপথেও একই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটল। সামনের ও পেছনের যাত্রীদের ভেতর থেকে একাধিকবার চা-নাশতার সরবরাহ পেয়ে বিস্ময়ের ঘোরে পড়লাম। বাঙালি স্বজনকে চিনতে দেরি করে না।

আমি এই নতুন পথে সফর করছি গাফ্ফার ভাইয়ের সৌজন্যে। আমার পকেটে টান পড়ছে বুঝতে পেরে গাফ্ফার ভাই নিজেই সব খরচপাতি চালাচ্ছেন। কারাবন্দি জীবনের সখ্য কখনো মলিন হয় না। ফেব্রুয়ারি ’৫৫-র কারা সান্নিধ্যে যে প্রীতিবন্ধন রচিত হয়েছিল বয়সের পার্থক্য ছাপিয়ে তা এই কয়েক দিনের পুনর্মিলনে আরো গাঢ় হয়েছে।

গাফ্ফার ভাই লেখার জগতে ডুব মেরেছিলেন। সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেন। আমি অকৃতি অধম ছাত্ররাজনীতির উত্তাল স্রোতে ভেসে এসে সাংবাদিকতার পেশাকেই জীবনের অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছি।

‘অন্যদেশ’ পত্রিকা ছিল আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর শেষ স্বপ্ন। বিশ্বমানের সেরা বাংলা কাগজ করতে চেয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টার পদ অলংকত করে। আমাকে সঙ্গে রেখেছিলেন তার নগণ্য কর্মী হিসেবে। অভিভাবকহীন হয়ে গেলাম।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সমান হতে কখনো পারিনি। সব সময় তার পেছনে ছিলাম। জীবনের শেষ লগ্নেও আমি তেমনি পেছনে পড়ে আছি। প্রিয় গাফ্ফার চৌধুরী মহাপ্রস্হানের পথে এগিয়ে গেলেন। তার চিরশান্িত কামনা করি।

লেখক: সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি, অন্যদেশ, নিউ ইয়র্ক

ইত্তেফাক/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন