শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে করণীয়

আপডেট : ২৫ মে ২০২২, ০৫:০০

মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ইতিমধ্যে সাড়ে ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি আমেরিকা, ব্রিটেন প্রভৃতি উন্নত দেশেও বেড়েছে। করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে এই সমস্যাটা এখন অধিকাংশ দেশের।

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো অর্থের জোগান বৃদ্ধি। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশে অর্থ সরবরাহের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭৩-১৯৭৪ সালে দেশে অর্থ সরবরাহের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭৪৫ কোটি টাকা। ২০০৭-০৮ সাল নাগাদ অর্থ সরবরাহের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫৯ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। ২০১০-১১ সাল নাগাদ অর্থ সরবরাহের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৭ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। আর এখনকার হিসাব না হয় নাই-বা লিখলাম। এ ছাড়া বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো উৎপাদন হ্রাস। কৃষিক্ষেত্রে আগের তুলনায় উৎপাদন বাড়লেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এখনো তা আশানুরূপ নয়, যদিও কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের সফলতা রয়েছে। তবে এখনো নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য আমাদের আমদানি করতে হয়। চাল, ডাল, ভোজ্য তেল ও চিনিসহ বিভিন্ন অপরিহার্য পণ্যে এখনো আমাদের আমদানি-নির্ভরতা রয়েছে।

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিভিন্ন খাতে সরকারকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এসব ব্যয়ের বিপরীতে সমপরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ তীব্রতর হচ্ছে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের দরুন বাংলদেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ খাদ্যঘাটতি দেখা দেয়। দেশে চাহিদার তুলনায় খাদ্যশস্যের উৎপাদন কম হওয়ায় খাদ্যশস্যের মূল্য এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যও বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দেশে সার্বিক মূল্যস্তর বৃদ্ধি পায়। অবমূল্যায়নের ফলে টাকার বাহ্যিক মূল্য হ্রাস পায়। এর ফলে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং দেশের অভ্যন্তরে মূল্যস্ফীতি ঘটে। স্বাধীনতা লাভের পর বহুবার ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।

১৯৭১-৭২ সালে টাকা ডলারের গড় বিনিময় হার ছিল ১ ডলার = ৭.৩০ টাকা। ২০১১-১২ সালে টাকা ও ডলারের গড় বিনিময় হার দাঁড়ায় ১ ডলার = ৭৮.১৮ টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশি টাকায় ডলারের অফিশিয়াল বিনিময় হার হলো ৮৭.০০ টাকারও বেশি। বাস্তবে তা ৯৬ টাকারও বেশি। টাকার এই অবমূল্যায়ন বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণে সরকারকে বিভিন্ন সময়ে গ্যাস, তেল ও বিদু্যতের মূল্য বাড়াতে হয়েছে। এর ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট না হওয়া সত্ত্বেও কিছুসংখ্যক পণ্য ব্যাপক হারে রপ্তানি করা হয়। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয় এবং এসব দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।

বিশ্বের বাজারে পেট্রোলিয়াম, গম, ভোজ্য তৈল, সার, সিমেন্ট ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির দরুন বাংলাদেশে এসব আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্পাদনের বিভিন্ন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, যেমন—শিল্পের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ, কাগজ ও নিউজপ্রিন্ট এবং পেট্রোল ও পেট্রোলজাত দ্রব্যের সরবরাহ মূল্যবৃদ্ধির দরুন উৎপাদন ব্যয় যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। মজুতদার, কালোবাজারি, মুনাফাখোর, চোরাচালানি প্রভৃতি অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেদের হীনস্বার্থ উদ্ধারের জন্য দেশের অভ্যন্তরে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রীর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে চলেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো পরোক্ষ করের প্রভাব। বাংলাদেশের রাজস্ব বাজেটের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই আসে পরোক্ষ কর থেকে। বাণিজ্য শুল্ক, আবগারি শুল্ক, মূল্যসংযোজন কর প্রভৃতি পরোক্ষ কর ধার্যের ফলে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপ তীব্রতর হয়েছে। স্বাধীনতার পর জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির দরুন বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারীবৃন্দ এবং বিভিন্ন শ্রমিক-সংঘ বেতন ও মজুরি বৃদ্ধির জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। স্বাধীনতার পর কয়েক দফা সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী ও শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি পায়। ২০১০ সালের গোড়ার দিকে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে দ্রব্যসামগ্রীর উত্পাদন বাড়েনি। এ কারণে বেতন বৃদ্ধির ফলে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায় মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে যেসব ব্যবস্হা অবলম্বন করা হয়, তাকে মোটামুটি তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে; যথা—(ক) আর্থিক ব্যবস্থা, (খ) রাজস্বসংক্রান্ত ব্যবস্থা এবং (গ) প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। (ক) আর্থিক ব্যবস্থা :মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণই হলো অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতি দূর করতে হলে অর্থের পরিমাণ কমাতে হবে। এ অর্থের পরিমাণ কমাতে হলে ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের পরিমাণও কমাতে হবে। কারণ, বর্তমান অর্থ ব্যবস্হায় ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের সাহাঘ্যে বহু লেনদেন হয়ে থাকে। এ ঋণের পরিমাণ কমাতে পারলে মোট প্রচলিত অর্থের পরিমাণ কমে যায় এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ উদ্দেশ্যে প্রত্যেক দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করে থাকে, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান উপায় হলো ব্যাংক হার বৃদ্ধি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংককে টাকা ধার দেয় তাকে ব্যাংক হার বলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যাংক হার বাড়ালে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও তাদের সুদের হার সাধারণত বাড়িয়ে দেয়। ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ ব্যয়সাধ্য হয়ে পড়ে এবং ঋণের পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। এভাবে মুদ্রাস্ফীতির সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যাংক হার বাড়িয়ে দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক সময় খোলাবাজারে সরকারি ঋণপত্র বিক্রয় করে ব্যাংক সৃষ্ট অর্থের পরিমাণ কমাতে চেষ্টা করে। এরূপভাবে ঋণপত্র বিক্রয় করলে ক্রেতাগণ তাদের নিজ নিজ বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর চেক কেটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাওনা মিটিয়ে তাকে। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণদান ক্ষমতা কমে যায়। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে ঋণপত্র বিক্রয় করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকের রিজার্ভের হার পরিবর্তন, নৈতিক চাপ প্রয়োগ, প্রত্যক্ষ ঋণ নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতির সাহাঘ্যে ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে মুদ্রাস্ফীতি দূর করার চেষ্টা করে। মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণে এখন থেকেই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

লেখক :বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.

ইত্তেফাক/ইউবি 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন