একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে জুন ২০২২-এর ৯ তারিখে মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হতে যাচ্ছে আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট। এক দিকে রয়েছে করোনা-পরবর্তী অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন খাতে বরাদ্দসহ এবং প্রণোদনা-ভতুর্কি বাবদ ব্যয় বাড়ানোর চাহিদা। অন্যদিকে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহারে সংযত হওয়ার চাপও রয়েছে।
এই দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য করে কীভাবে এগোতে হবে, সেই নির্দেশনা বাজেট প্রস্তাবে থাকবে—এমনটিই সবার আশা। একই সঙ্গে বাড়ন্ত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার নীতি-কৌশলের পাশাপাশি অল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য সম্প্রসারিত সামাজিক নিরাপত্তার জন্যও বাড়তি বরাদ্দের কথা ভাবতে হচ্ছে। অন্যদিকে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি উপকরণে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবহন ব্যয় ও নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য উপযুক্ত পরিমাণ ভতুর্কি বাবদ বাজেট বরাদ্দ রাখার প্রয়োজনও অনস্বীকার্য। এক কথায় বলা যায়, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখে এগিয়ে যাওয়াই হতে হবে আসন্ন বাজেটের মূল লক্ষ্য। সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে এবং দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো পর্যন্ত যে ব্যবস্থাগুলো নিয়েছে তার আলোকে বলা যায় যে, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিকৌশল সঠিক পথেই এগোচ্ছে।
এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে, মাত্র এক যুগের কিছু বেশি সময় আগেও আমরা গুরুতর বিশ্ব আর্থিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ খুবই মুনশিয়ানার সঙ্গে কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। শুধু তা-ই নয়, ঐ সংকট কাটিয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা আর অর্থনীতির কম্পারেটিভ অ্যাডভানটেজগুলোকে কাজে লাগিয়ে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করতে সক্ষম হয়েছি। ২০০৯ সালের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই এই অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। সরকারের অপরাপর নীতিনির্ধারকরাসহ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি ব্যাপকভিত্তিক আর্থিক অন্তভুর্ক্তির অভিযান সফলভাবে সম্পন্ন করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকন্যার এই অভিযাত্রায় যথাযথ সহায়তাই করেছে বলা যায়। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা আত্মবিশ্বাসী হতে পারছি যে, চলমান আর্থিক টানাপড়েন কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব। বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে মুদ্রানীতি খানিকটা সংকোচনমূলক করার উদ্যোগ নিয়েছে। রেপোর হার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছে। মুদ্রামানও বাজার-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ সাপেক্ষে ধীরে ধীরে সমন্বয় করে যাচ্ছে। তাছাড়া ম্যাক্রো-প্র‚ডেন্সিয়াল নীতির মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় আমদানিও নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারও এসব নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সহায়ক শুল্কনীতিতে পরিবর্তন এনেছে। এইভাবে নীতি সমন্বয় করে যেতে পারলে নিশ্চয় অর্থনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। বাজেট এই নীতি-কৌশলকে আরো কার্যকরী সমর্থন দেবে, সেই প্রত্যাশাই করছি।
সামষ্টিক অর্থনীতির সমকালীন বাস্তবতা ও সম্ভাবনা এবং ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির বিবেচনায় আসন্ন অর্থবছরের জন্য কিছুটা সতর্ক বাজেটই কাম্য। তবে এই সতর্ক বাজেটেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষার মতো খাতগুলোতে বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে কাটছাঁট করা কাম্য নয়। বরং মানুষের ওপর বিনিয়োগ আরো বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য সীমিত সম্পদ কীভাবে আরো কার্যকরভাবে কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়েই নির্দেশনা আসা উচিত বাজেটে। এই নীতি-কৌশলের অংশ হিসেবেই স্বাস্থ্য খাতের কথা আলাদা করে ভাবা দরকার। বিগত দুটি বাজেট প্রস্তাবের সময় করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং সবার জন্য টিকার ব্যবস্থা করা মুখ্য বিবেচ্য ছিল। তাই হয়তো টিকে থাকার জন্য জরুরি ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে স্বাস্থ্য খাতের অন্যান্য দিকে সেভাবে নজর দেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে করোনা মোকাবিলার অভিজ্ঞতার আলোকে এ খাতকে ঢেলে সাজিয়ে আরো গণমুখী করার উদ্যোগ দেখতে চাইছেন সকল অংশীজনই।
সচরাচর মোট জাতীয় বাজেটের ৫ থেকে ৬ শতাংশের মতো বরাদ্দ দেওয়া হয় স্বাস্থ্য খাতের জন্য। এই অনুপাত অবশ্যই বাড়ানো দরকার। তবে এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে হার দেখেছি, স্বাস্থ্য বাজেটের আকার বেড়েছে তার চেয়ে বেশি হারে। এটিকে স্বাস্থ্য খাতে বাড়তি বরাদ্দের চাহিদার প্রতি নীতিনির্ধারকদের সংবেদনশীলতা হিসেবেই দেখতে চাই। এর পরও বলতে হবে যে, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যয় বেশ কম। জিডিপির শতাংশ হিসাবে বাংলাদেশের কারেন্ট হেলথ এক্সপেন্ডিচার (সিএইচই) মাত্র ২.৩ শতাংশ। মাথাপিছু সিএইচইর হিসাবেও বাংলাদেশ প্রতিবেশী নেপাল, ভারত, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে। বাংলাদেশের মাথাপিছু সিএইচই বা স্বাস্থ্য খরচ যেখানে ৪৫ ডলার, সেখানে এই প্রতিবেশী দেশগুলোর যথাক্রমে ৫৮, ৭৩, ১০৩ এবং ১০৭ ডলার (২০২০ সালের হিসাব অনুসারে)।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করেই বলা যায় যে, আমরা স্বাস্থ্য খাতে যথেষ্ট ব্যয় করছি না। এর চেয়েও বড় কথা হলো এই অপ্রতুল স্বাস্থ্য ব্যয়েরও দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসছে নাগরিকদের পকেট থেকে (যাকে বলা হয় আউট-অব-পকেট কস্ট)। নাগরিকরা নিজেরা স্বাস্থ্যসেবার জন্য যে ব্যয় করেন তার আবার বড় অংশটি যাচ্ছে ওষুধ ও সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজ তথা আনুষঙ্গিক চিকিৎসাসামগ্রী বাবদ (৬৭ শতাংশ)। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হেলথ ইকোনমিকস ইউনিটের প্রস্তুত করা ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের ষষ্ঠ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। কাজেই স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি যেমন প্রতিবেশী দেশের ব্যয় এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সূচকের ভিত্তিতে করা যাচ্ছে, তেমনি নাগরিকদের ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপের এই পরিসংখ্যান থেকে স্বাস্হে্যর বাড়তি বরাদ্দ কোথায় দিতে হবে, সে সম্পর্কেও একটি ধারণা পাওয়া যায়। যেহেতু ওষুধ কেনা বাবদই নাগরিকদের সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে, তাই স্বাস্থ্য বাজেটের বর্ধিত বরাদ্দের একটি বড় অংশ নাগরিকদের বিনা মূল্যে বা ভতুর্কি মূল্যে ওষুধ সরবরাহের জন্য রাখা দরকার। বর্তমানে মোট স্বাস্থ্য বাজেটের ২০ শতাংশের মতো এই উপখাতে যায়। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, এই বরাদ্দের অনুপাত দ্বিগুণ করা গেলে স্বাস্থ্যব্যয়ে নাগরিকদের অংশ ৫০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব। তবে এর বিতরণ হতে হবে স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক।
দেশে স্বাস্থ্যসেবাপ্রার্থীদের বড় অংশটি মূলত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাপ্রার্থী—এটা নিশ্চিত। তবু মোট স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র এক-চতুর্থাংশের মতো এ বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বাবদ বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানোর জন্যও তাই স্বাস্থ্য বাজেটের আকার বাড়ানো চাই। তবে এ প্রসঙ্গে বলে রাখতে চাই যে, স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ খাতের বরাদ্দ ব্যয়ের দক্ষতার অভাব একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে এ কথাটি হয়তো বেশি প্রযোজ্য। প্রায়শই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য দেওয়া উন্নয়ন বরাদ্দের প্রায় অর্ধেকই অব্যয়িত থেকে যায়। তবে এটিকে এ খাতে যথাযথ বরাদ্দ না দেওয়ার কারণ হিসেবে দাঁড় না করিয়ে কীভাবে এ খাতে বরাদ্দ বাস্তবায়নের দক্ষতা বাড়ানো যায়, সেদিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার বলে মনে করি। আমার মনে হয়, যে মন্ত্রণালয়গুলো বরাদ্দ বাস্তবায়নে দক্ষতা বেশি দেখাচ্ছে তাদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যয়দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব। একই সঙ্গে অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেও তা বাড়ানো যেতে পারে।
এখানে যেসব বিষয় আলোচিত হলো সেসবই স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দের স্বল্পমেয়াদি নীতি-পরামর্শ। দীর্ঘ মেয়াদে দ্রুত বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির উপযোগী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের পুরো স্বাস্থ্য খাতকেই ঢেলে সাজানো দরকার বলে মনে করেন অনেক অংশীজন। সেজন্য খুব বেশি অ্যাডভেঞ্চারাস উদ্যোগ এখনই নেওয়া হয়তো ঠিক হবে না। তবে ধীরে ধীরে আমাদের একটি ব্যাপকভিত্তিক পরিবর্তনের পথে হাঁটতেই হবে। এজন্য মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে সংস্কারমূলক নীতি-কৌশল বাস্তবায়নের জন্য আমাদের এগোতেই হবে। আমার মনে হয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসডিজির স্বাস্থ্যবিষয়ক লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য একটি ছয় থেকে আট বছর মেয়াদি সুনির্দিষ্ট কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ নিতে পারে। এই পরিকল্পনা প্রণয়নে সরকারের বাইরে থাকা বিশেষজ্ঞদেরও যুক্ত করা যেতে পারে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশের নাগরিকরা এখনো স্বাস্থ্যসেবার জন্য ব্যক্তি খাত ও অ-সরকারি খাতের ওপর ব্যাপক মাত্রায় নির্ভরশীল। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এই মহাপরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় এই অংশীজনদের ওতপ্রোতভাবে যুক্ত রাখার বিকল্প নেই। আসছে অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে স্বল্পমেয়াদি বরাদ্দসংক্রান্ত নীতি প্রস্তাবনাগুলোর পাশাপাশি এমন দীর্ঘমেয়াদি বিবেচনাগুলোও কিছুটা হলেও প্রতিফলিত হবে—সেই প্রত্যাশাই রাখছি। কেননা বাজেট শুধু বরাদ্দের হিসাবনিকাশ নয়। এটি সুদূরপ্রসারী নীতি পরিকল্পনার বার্ষিক সালতামামিও বটে।
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি