শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শিক্ষার শক্তি বাড়াতে করণীয়

আপডেট : ০১ জুন ২০২২, ০৭:৪৭

শিক্ষার শক্তি বাড়াতে ভালো একটি বই জাগ্রত শিক্ষকের মতো কাজ করে। আতশ কাচ যেমন সূর্যের সাধারণ রশ্মিকে বহু গুণ বাড়িয়ে কাগজে আগুন ধরাতে পারে, তেমনি প্রকৃত শিক্ষার শক্তি মেধাকে প্রজ্বালনের মাধ্যমে জাতিকে করতে পারে নিরাপদ, প্রজ্ঞাময় ও সমৃদ্ধিশালী। আমাদের সন্তানেরা প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিংনির্ভর হয়ে পড়েছে। ফলে পড়ালেখা নিয়ে নিজেদের মধ্যে যে আত্মপ্রত্যয় তৈরি হওয়ার কথা, সেটি হচ্ছে না। তাছাড়া সন্তানদের প্রাইভেট টিউটর ও কোচিংয়ের খরচ জোগাতেই বাবা-মাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষক হিসেবে আমার কিছু পরামর্শ এখানে সন্নিবেশিত করলাম।

আগে ভাবতাম শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পড়~য়া শিক্ষার্থীরা অনুধাবন করতে পারে যে শিক্ষক প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে এসেছেন কি না। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখলাম, শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও মূল্যায়ন করতে পারে যে শিক্ষক মহোদয় ক্লাসে প্রস্তুতি নিয়ে প্রবেশ করেছেন কি না! কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যদি কোনোভাবে বুঝতে পারে যে শিক্ষক মহোদয় প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে আসেননি, তাহলে ক্লাসের প্রতি তাদের মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। এতে শিখন প্রক্রিয়ায় দারুণ ব্যাঘাত ঘটে। সুতরাং শিক্ষক যে ক্লাসেরই হোন না কেন, তাকে প্রস্তুতি নিয়েই ক্লাসে আসতে হবে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে শতভাগ প্রস্তুতিসহ শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা জরুরি। মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞানে পরিষ্কার ধারণা থাকলেই কেবল বিজ্ঞানমনস্ক, গবেষণামুখী ও শিল্পোন্নত জাতি গড়ে তোলা সম্ভব।

বর্তমান প্রযুক্তির যুগে প্রযুক্তির ব্যবহারে চাই অর্থ ও প্রশিক্ষণ। প্রযুক্তির উত্পাদনে চাই কলকারখানা ও কাঁচামাল। প্রযুক্তির পরিবর্তনে চাই গবেষণা। গবেষণার সফলতায় চাই শিক্ষার শক্তি। শিক্ষার শক্তি আসে জ্ঞানের গুপ্তভান্ডার থেকে। জ্ঞানের গুপ্তভান্ডারের রত্ন হলো গণিত। যেসব জাতি প্রকৃত রত্নকে চিনেছে, সফলতার জন্য তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বেশি দূরে নয়, নিজ মহাদেশের শিল্পোন্নত দেশ চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করি। দেখব বিশ্বে গণিতের উৎকর্ষতার মাপকাঠিতে এদের অবস্থান যথাক্রমে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আয়োজিত ‘আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও অগ্রগতিতে করণীয়’ শীর্ষক কর্মশালায় যোগ দিয়েছিলাম। স্বাগত বক্তব্যে অনেকেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। আমি প্রযুক্তির শিক্ষক হয়ে এটুকু বিশ্বাস করি, এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাও অগ্রগতির জন্য গণিতের ভিতকে স্কুল ও কলেজ পর্যায় থেকেই সুসংহত করতে হবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২৪ মে ২০২২ একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ‘ইংরেজি-গণিতে এখনো দুর্বল শিক্ষার্থীরা’। গবেষণাধর্মী এই রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজিতে ৬১ শতাংশ ও গণিতে ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক। এখানে উল্লেখ্য, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, ফ্রান্সসহ শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ইংরেজির ব্যবহার খুবই সীমিত। তথাপি গণিতের পারদর্শিতায় তাদের অবস্থান বিশ্বজোড়া স্বীকৃত। সুতরাং গণিতের পারদর্শিতা ছাড়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবসহ অন্যান্য শিল্পের উন্নয়ন সুদূর পরাহত। গণিতের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রগাঢ় অনুধাবন ও ভিত্তি জ্ঞান তৈরির জন্য গণিতের যে কোনো শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের যে কোনো অধ্যায়ের অনুশীলনী শুরুর আগে আলোচনামূলক যে অংশটি থাকে তার প্রতিটি শব্দ ও সংখ্যা ভালোভাবে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে। তারপর ঐ অধ্যায়ের গণিতের উদাহরণগুলো শেষ করে পরবর্তী ধাপে অনুশীলনীতে অন্তভু‌র্ক্ত গণিত শুরু করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের ভিত্তি জ্ঞান পোক্ত হবে। স্কুল-কলেজগুলোতে গণিত শিক্ষার ক্ষেত্রে এমন পদ্ধতি অবলম্বন করলে অভাবনীয় সুফল পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

নবম ও দশম শ্রেণির বিজ্ঞানবিষয়ক পাঠ্যবইগুলো সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রি আছে এমন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান পরিচালনা করলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার শক্তি বাড়বে। জ্ঞানের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সাধনের জন্য বিজ্ঞানের বইগুলো লেখার ক্ষেত্রেও থাকতে হবে সদা সতর্ক। খেয়াল রাখতে হবে, বইগুলো যেন এমনভাবে লেখা হয়, যাতে কোনো কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনি ছাড়াই একজন আগ্রহী শিক্ষার্থী চাইলে নিজ উদ্যোগে বইকে জাগ্রত শিক্ষকের মতো ব্যবহার করতে পারে। নবম ও দশম শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নের ‘গ’ ও ‘ঘ’ অংশে সাধারণত পদার্থবিজ্ঞান-বিষয়ক গণিত থাকে, যার সিংহভাগই পাঠ্যবইয়ে উদাহরণ বা অনুশীলনীর অংশ হিসেবে অন্তভু‌র্ক্ত নয়। এর জন্য একমাত্র ভরসা গাইড বই। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রতি অধ্যায়ে পর্যাপ্তসংখ্যক অঙ্ক উদাহরণ ও অনুশীলনী হিসেবে অন্তভু‌র্ক্ত করা দরকার।

মেয়েকে পড়াতে গিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখলাম, মাধ্যমিকের বিজ্ঞানের বইগুলো যদি ৪০০ পৃষ্ঠার হয়, তাহলে তার গাইড বইগুলোর কলেবর ১ হাজার পৃষ্ঠা। এক্ষেত্রে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত’। নবম শ্রেণির সাধারণ গণিত বইয়ের পরিমিতির ১৬.১ অধ্যায়ের ৭ নম্বর প্রশ্নের সমাধান করতে গিয়ে দেখেছি, একপর্যায়ে একটি সমীকরণ আসে। এমন একটি সমীকরণের মিডল টার্ম ফ্যাক্টর আসুন আমরা হাতে-কলমে করে দেখি কত সময় লাগে। এ ধরনের বড় সংখ্যা দিয়ে কোনো সমীকরণের মিডল টার্ম ফ্যাক্টর করতে দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক? নবম শ্রেণির উচ্চতর গণিতের ৫.৫ অধ্যায়ের এমন কিছু গণিত অনুশীলনীতে দেওয়া আছে, যার প্রকার উদাহরণে দেখানো নেই। এমতাবস্থায় এই বইটি উত্সাহী শিক্ষার্থীর জন্য জাগ্রত শিক্ষকের মতো কাজ করবে কি?

আজকের বাংলাদেশ জননেত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ। এর সুফল আমাদের শতভাগ গ্রহণ করতে হবে। প্রকাশিত বইয়ের ক্ষেত্রে বিষয়সংশ্লিষ্ট শিক্ষকবৃন্দের ব্যবহার-পরবর্তী মতামত আমরা স্পেশাল সার্ভারের মাধ্যমে সারা বছর গ্রহণ করতে পারি। বই সম্পর্কিত তাদের মূল্যবান মতামত ও পরামর্শ শিক্ষার শক্তি বাড়াতে সহায়ক হবে। খেলাধূলা ও শরীরচর্চা করলেই কেবল উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা সৃষ্টিকারী কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন হরমোন নিঃসরণ হ্রাস পায়। তত্সঙ্গে আনন্দ ও সুখের হরমোন অক্সিটোসিন, সেরোটোনিন ও ডোপামিন বৃদ্ধি পায়। এতে মানসিক ও শারীরিক সুস্হতার সমন্বয় সাধিত হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের প্রতি একাগ্রতা আনতে পারে এবং যে কোনো মানসিক চাপ ও উৎকণ্ঠায় নিজেকে অবিচল ও স্থির রাখতে পারে। তাই শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা ও কায়িক পরিশ্রমের বিষয়টিকে পড়াশোনার মতোই গুরুত্ব দিতে হবে। তবেই গড়ে উঠবে শিক্ষার শক্তিতে বলীয়ান উন্নত বাঙালি জাতি।

 

লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/ইউবি