সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সীমার মাঝে অসীম তুমি

আপডেট : ০৩ জুন ২০২২, ০৯:১৭

অনন্ত প্রেমময় বাবা লোকনাথ ২৯ বছর বারদীধামে গৃহী সন্ন্যাসী সেজে মানুষের মধ্যে লৌকিক লীলার মাধুর্যে মানুষকে আলোর পথে আকর্ষণ করেছিলেন— যা আজও চলমান। সমতলভূমিতে অবতরণ করার দুটি উদ্দেশ্য ছিল— একটি মায়ের আকাঙ্ক্ষা পূরণ, অপরটি গুরুদেবকে উদ্ধার। কিন্তু ভক্তকুল সাধারণ মানুষ ভেবে সব মাটি করে ফেলল! এটি ছিল অমৃত পুরুষ বাবা লোকনাথের করুণার্থ হূদয়ের ভাব না বোঝার কিংবা না অনুভব করার আক্ষেপ। অবতারলীলা মাহাত্ম্য অনুভব সহজসাধ্য বিষয় নয়। ক্ষুদ্রবুদ্ধি ও সীমিত চেতনা নিয়ে অসীমের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। মানুষ তৈরির কারিগর যখন নিজেই মানুষের মধ্যে মানুষের বেশে মানুষের পোশাকে লীলায় মত্ত হন— তখন কার সাধ্য তাকে ধরে! বাবা নিজেই বলেছেন— কার বাপের সাধ্য আমায় ধরে! আমি ধরা দিই বলেই আমাকে ধরতে পারিস। কবিগুরুর ভাষায়— ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর/ আমার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই তো এত মধুর।’

লীলাচ্ছলে মানুষের ব্যথাবেদনা, জ্বালা, যন্ত্রণা নিজে বহন করেছেন। আবার কী করে মানুষ এসব দুঃখকষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে আলোর পথে হাঁটতে পারে সেই পথনির্দেশও তিনি দিয়েছেন। মানুষ অর্থাত্ ভক্তকুলকে আদর্শের পথে আলোর পথে আনতে কতই-না গঞ্জনা ও বিদ্রুপ সইতে হয়েছে! কত রোগ-যন্ত্রণা দেহে ধারণ করে ধ্যানমগ্ন থাকতে হয়। রাজাধিরাজ রামচন্দ্রকেও বনবাসে যেতে হয়েছিল। অত্যাচারী কংসের কারাগারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে আবির্ভূত হতে হয়েছিল। জগাই-মাধাই মাতালের আক্রমণে মাথা ফেটে রক্ত বের হলেও মহাপ্রভু নিমাইকে প্রেম বিলাতে হয়েছিল। জরাসন্ধ ও শিশুপাল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হাতে নিহত হলেও অসত্ চরিত্রের খুনি দুর্যোধন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে চিনতে ভুল করলেন। ভুল করলেন তৎকালীন বারদীনিবাসী লোকজন। চিনতে পারলেন না বারদীধীশকে বা বারদীনাথকে। চিনতে না পারার কারণ ক্ষুদ্রবুদ্ধি ও সীমিত জ্ঞানযুক্ত লোকদের আত্ম-অহংকার ও উদাসীনতা। ‘আমার চরণ ধরিস না আচরণ ধর’— বারদীর গোঁসাই বাবার আচরণ লক্ষ করলে বোঝা যায় যে, তিনি কতটা সন্তানবাত্সল্য ছিলেন।

তিনি বিশেষ শ্রেণি-পেশার বা সম্প্রদায়ের গুরু নন। বাবা শিষ্যকুলের প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে প্রসার করলেন শিষ্য ও ভক্তদের সমন্বয়ে গঠিত ভক্তির আবেশযুক্ত ভক্তকুল— যেখানে জাতপাতের ভেদাভেদ নেই— আছে কেবল সম্প্রীতির বন্ধন। বিষয়ী মানুষকে কর্মমার্গে আকর্ষণ করে বিশুদ্ধ কর্মমার্গে পরিচালনার ভেতর দিয়ে তিনি ধন্য করেন। সমাজের উঁচুনিচু, ছোটবড়, ধনীগরিব, ধার্মিক-অধার্মিক, মূর্খ-পণ্ডিত, সুস্হ-অসুস্হ, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী— সবার প্রতি বারদীর গোঁসাই বাবার অফুরন্ত পবিত্র করুণাপ্রবাহের অমৃতধারা বহমান। ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিবেশী ও সমাজের মাঙ্গলিক চেতনা বিকাশে তার দূরদর্শিতার অনেক তথ্য পাওয়া যায়। যেমন :এ সময়ে এক সংসারী মা তার কাছে ব্রাহ্মণের দেওয়া শ্রাদ্ধের ফর্দ নিয়ে এসেছিলেন। বাবা ফর্দ দেখে ব্রাহ্মণকে বুঝিয়ে দিলেন ফর্দ ছোট করে আপনার ব্যবহার উপযোগী দ্রব্যসমূহ নেওয়ার জন্য, কারণ গামছা ছোট দেওয়া হলে ব্যবহার করা যাবে না। এজন্য বাবা আকার ইঙ্গিতে ফর্দ ছোট করে ব্যবহার উপযোগী গামছা দেওয়ার প্রস্তাব করেন। এতে পূজারি ব্রাহ্মণ ও সংসারী মা খুশি হলেন। এভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি অনুষ্ঠানের ফর্দ তৈরি করে দিয়ে সমাজভুক্ত সব সম্প্রদায়ের সমন্বয় বহাল করেছিলেন।

‘যার প্রভাবে মোহ আসে/ তা আমার জানা আছে’ —গোঁসাই বাবা মোহকে মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করতেন। ইচ্ছাধীন মৃত্যু তার এই উক্তি থেকেই অনুভব করা যায়। ভগবত্ সাযুজ্য লাভ করেও ভক্তকুলের ডাকে সাড়া দিয়ে বারদীতে লীলায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। ‘আমি দেখেছি আমাকে’— তার এ উক্তিটি গীতার যোগ-মার্গের ভগবত্-দর্শনের ইঙ্গিত বহন করে। এ অবস্থায় যোগী সর্বভূতেই ‘আমিময়’ আর ‘আমিই সর্বভূতময়’— দর্শন করেন। মদগুরু জগদ্গুরু মদাত্মা সর্বভূতাত্মা। এই অবস্থায় যোগী ভগবানে ও আপনাতে পার্থক্যহীন অনুভব হয়, কোনো রকম স্বাতন্ত্র্য অনুভূত হয় না। ভুবনময় ভগবানে ও আমি অভিন্ন— একেই বলা যেতে পারে ভগবত্ সাযুজ্য।

উপরিউক্ত ব্যাখ্যাটি শ্রীগীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে উল্লেখ পাওয়া যায়।

ব্রহ্মভূত ষড়ৈশ্বর্যময় গোঁসাই বাবা এই পুণ্যধাম বারদীতে লীলার ছলে মানুষের মধ্যে ধর্মকর্ম, সত্যনিষ্ঠা, নিয়মঅনিয়ম, পাশব ও পশুত্ববুদ্ধিসম্পন্ন প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে সচেতন ভাবনার বিকাশ করতে তার আগমন। বাবা লোকনাথের অসীম মহিমা অবোধ্য ও অব্যক্ত। তার ধ্যান, জ্ঞান লীলা-করুণা অনন্ত— আমরা অজ্ঞানী-সাধন ভজনহীন ভক্তিহীন ওহে তমোহর বিশ্বেশ্বর তুমি নিজগুণে কৃপা করে তমসাচ্ছন্ন সন্তানদের ক্ষমা করে তোমার চরণধুলায় আশ্রয় দিয়ো। তোমাকে শতকোটি প্রণাম।

লেখক: শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম ও মন্দির পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন