মহামারি (করোনা) জনিত প্রাক্কাল উপেক্ষা করলেও বিশ্ব জুড়ে প্রতি বছর স্বাস্থ্য ব্যয়ের পরিমাণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েই চলেছে। যেমন— ২০০০ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ছিল ৯ মার্কিন ডলার, যা ২০১৯-এ এসে ৪৬ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও স্বাস্থ্য ব্যয় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই যে, প্রতিবছর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে অনিরাপদ খাদ্যের দরুন সার্বিক উৎপাদনশীলতা এবং স্বাস্থ্য ব্যয়ে প্রায় ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়। দূষিত খাবার খাওয়ার ফলে বিশ্বে প্রতি ১০ জনে এক জন অসুস্থ হয় এবং গড়ে প্রতি বছর ৪ লাখ ২০ হাজার জন মারা যায়। অর্থাত্ প্রায় ৩৩ মিলিয়ন সুস্থ জীবন প্রতি বছর নষ্ট হয়। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুরা ৪০ শতাংশ খাদ্যবাহিত রোগের বোঝা বহন করে এবং গড়ে প্রতি বছর ১ লাখ ২৫ হাজার জন মারা যায়।
অনিরাপদ খাদ্যসমূহ মূলত ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, পরজীবী বা রাসায়নিক পদার্থের আধার। এ ধরনের খাদ্যসামগ্রী খাবার ফলে পেটের অসুখ থেকে ক্যানসার পর্যন্ত ২০০টিরও বেশি রোগ হয়ে থাকে। অনিরাপদ খাদ্য হলো সেই ধরনের খাদ্য, যার প্রকৃতি, উপাদান বা গুণমান নানা উপায়ে এমনভাবে প্রভাবিত হয় যে তা মানুষের স্বাস্থে্যর জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। এর কিছু হয় প্রাকৃতিক উপায়ে, অর্থাত্ যা উৎপাদনক্ষেত্র থেকে বা খাদ্যের সঙ্গে আসে। তবে খাবার অনিরাপদ হয় মূলত কৃত্রিম পন্থায়, যেমন—উৎপাদনে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার বা কীটনাশকের ব্যবহার, সংরক্ষণের জন্য ব্যবহূত ক্ষতিকর প্রিজারভেটিভ, বাহ্যিক চাকচিক্য বা স্বাদ বৃদ্ধির জন্য ব্যবহূত রাসায়নিক দ্রব্য, প্রসেসিং ও পরিবেশনজনিত জটিলতা, ক্ষতিকর দ্রব্য মেশানো ইত্যাদি।
অনিরাপদ বা দূষিত খাবার থেকে পরিপাকতন্ত্রের (যেমন—ডায়রিয়া, আমাশয়) রোগগুলি সবচেয়ে বেশি হয়। যার ফলে প্রতিবছর ৫৫০ মিলিয়ন মানুষ অসুস্থ হয় এবং ২ লাখ ৩০ হাজার জন মারা যায়। মূল কথা, অনিরাপদ খাদ্যজনিত সমস্যাগুলি স্বাস্থ্যসেবাসহ জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনীতি, পর্যটন ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনাকে চাপে ফেলে, ফলে সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের পরিভাষায়, কোনো জাতিকে জীবন টিকিয়ে রাখতে এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের বিকল্প নেই। এক কথায়, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যই হলো সুস্বাস্থে্যর প্রাথমিক ও অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি। নিরাপদ খাদ্য, পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কেননা অনিরাপদ খাদ্য রোগ ও অপুষ্টির এক দুষ্ট জালক তৈরি করে, যা শিশু থেকে বয়স্ক সবার স্বাস্থ্যহুমকির প্রধান প্রভাবক।
বর্তমানে বাংলাদেশের খাদ্যবাজারগুলি অনিরাপদ বা অস্বাস্থ্যকর খাবারে পরিপূর্ণ। অন্যদিকে, বিরাট একটি জনগোষ্ঠী নিয়মিত লড়াই করে চলেছে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বেড়ে চলা নিত্যপণ্যের সঙ্গে। স্বল্প আয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে হেরে বাধ্য হচ্ছে নিম্নমানের দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে কোনোরকম জীবন অতিবাহিত করতে। এদের কাছে পেটের চাহিদা একটি গুরুতর বোঝা। ২০১৯ সালের সরকারি হিসেব মতে, বাংলাদেশের প্রায় ২১ শতাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এই শ্রেণির মানুষগুলো মন চাইলেও অধিক মূল্য দিয়ে মানসম্মত খাবার কিনতে পারে না। বাধ্য হয়েই এক রকম পেট ভরানোর তাগিদে তারা নিম্নমানের খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করে, যা তাদের পুষ্টিহীনতা ও খাদ্যজনিত বহুবিধ সমস্যার অন্যতম প্রধান দুটি কারণ।
শুনতে মন্দ লাগলেও এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, আমাদের বিরাট একটি জনগোষ্ঠী (ধনী শ্রেণিসহ) জানেই না যে তারা কী খাচ্ছে! উদাহরণস্বরূপ, দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণর্ধার যেমন— স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ— তাদের অধিকাংশই নানারকম অস্বাস্থ্যকর খাবার (যেমন— ভাজা-পোড়া, ফাস্টফুড, রিচ ফুড ইত্যাদি) দিয়ে নিয়মিত পেট ভরাচ্ছে। পুষ্টিবিজ্ঞানের ভাষায়, এগুলো মূলত জিহ্বার খাবার, শরীরের নয়। টক্সিকোলজির পরিভাষায়, খাবারের টক্সিক ইফেক্ট মূলত দুই ধরনের : (১) তাত্ক্ষণিক ইফেক্ট, যা বিষাক্ত বা অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে (কয়েক মিনিট থেকে ঘণ্টার মধ্যে) শুরু হয় এবং (২) ক্রনিক ইফেক্ট, যা অনিরাপদ খাদ্যগ্রহণের দীর্ঘ সময় (কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর) পর শুরু হয়। অনিরাপদ খাবার গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই বদ হজম, ডায়রিয়া, আমাশয় ইত্যাদি রোগই মূলত তাত্ক্ষণিক ইফেক্ট।
অন্যদিকে, এই ধরনের খাদ্য দীর্ঘ দিন খেয়ে যাওয়ার ফলে যে বিষক্রিয়া হয়, তা আরো মারাত্মক। খাদ্যের টক্সিনসমূহ শরীরে জমতে জমতে মাত্রাতিরিক্ত হলে শরীরে দেখা দেয় নানা রোগব্যাধি, যা বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে বহুবিধ জটিল থেকে জটিলতর আঘাত হানে। দুই ধরনের ইফেক্টই বিষাক্ত খাদ্যজনিত মানুষের মৃতু্যর কারণ হতে পারে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় যে, বর্তমানে বাংলাদেশের হূদ্রোগ থেকে শুরু করে প্রায় সব রোগব্যাধিই আর বয়স মানছে না। অথচ এই ধরনের রোগব্যাধিগুলোর ব্যাপ্তি এখন থেকে এক যুগ আগেও এমনটা ছিল না।
সুতরাং, এখনই সময় জাতীয় পর্যায়ে একটি উন্নত ও কার্যকরী নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। সরকার, উৎপাদক এবং ভোক্তাদের মধ্যে একটি কার্যকরী সহযোগিতামূলক শৃঙ্খলা গঠনই পারে অনিরাপদ খাদ্যের কালো থাবা থেকে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ