আমরা গণতন্ত্র ভালোবাসি, গণতন্ত্রের কথা বলি কিন্তু যখনই বীরত্ব, গৌরব, সাহস, সততা, নিষ্ঠা ও বুদ্ধির কোনো গল্প নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বলতে যাই বা পাঠ্যসূচির মাধ্যমে শেখাতে চাই, দেখা যায় বেশির ভাগ ঘটনায় চলে আসে অগণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে রচিত বিভিন্ন রাজা-বাদশার গল্প। আমরা ম্যাসিডোনিয়ার রাজা তৃতীয় আলেকজান্ডারের গল্প বলি, গল্প পড়াই। তার নামের সামনে শ্রদ্ধাভরে মহামতি অভিধাটিও সংযুক্ত করি। কিন্তু তার বীরত্বগাথায় আছে ৩০ বছর বয়সে মিশর থেকে উত্তর-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার ইতিহাস। সেখানে যুদ্ধ হয়েছে, মানুষের নৃতাত্ত্বিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে, রক্তপাত হয়েছে, সব ধরনের মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। মডার্ন ডিসকোর্সে এসবকে সামাজ্যবাদ বলা হয়ে থাকে। এটি গণতন্ত্রের পরিপম্হি। এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। সেদিকে গেলে আলোচনার দৈর্ঘ্য বাড়বে।
আমি এ কথা বলছি এই কারণে যে, বাংলাদেশের বীরত্ব, গৌরব, সাহস ও সততার ইতিহাস বা উদাহরণ বলতে গেলে কোনো অগণতান্ত্রিক শক্তির কথা বলতে হবে না। আমাদের বীরত্ব, গৌরব ও মুক্তি, মানবিক অধিকার ও উন্নয়নের গণতান্ত্রিক উদাহরণ আছে। আজ থেকে শত বৎসর পরে নয়, আমি সত্যিই বিশ্বাস করি যে ২০৪১ সালে বাংলাদেশে একটি উন্নত রাষ্ট্রের সব প্যারামিটারকে স্পর্শ করবে। যেখানে গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেদিন আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের কোনো নায়কের গল্প বলব বা শোনাব, সেটি আজ স্হির করতে হবে। আমার দৃষ্টিতে সে নায়কের নাম জননেত্রী শেখ হাসিনা।
কারণ কালের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিকে স্বাধীনতা দিয়েছেন, মুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু মুক্তি ও স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় যে লক্ষ্যটি ছিল, সেটি ছিল আর্থসামাজিক মুক্তির মধ্য দিয়ে আত্মনির্ভর, আত্মমর্যাদাশীল বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ। বঙ্গবন্ধু সে পথে সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের জিডিপি ইনডেক্স আমরা আজও অতিক্রম করতে পারিনি। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পরে বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে পশ্চাত্-যাত্রা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নকল্পে মৃতু্যর সমূহ সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করে তারই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেন এবং মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিলেন। জনগণের বিপুল সমর্থনে রাষ্ট্র-ক্ষমতায় বসে তিনি শুরু করলেন মানুষের দিনবদলের সংগ্রাম। তার এ সংগ্রাম পথে কতবার যে ১৫ আগস্ট ঘটানোর অপচেষ্টা করা হয়েছে তা আমাদের এই আলোচনায় বিবেচনায় নিতে হবে। অনেকগুলো চোখে দেখা গেছে, অনেকগুলো ঘটনা যায়নি।
তার মধ্যে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হতে পারত ১৫ আগস্টের মতোই ভয়াবহ ও নৃশংস। মহান আল্লাহ তায়ালায় অশেষ রহমতে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী বারবার মৃতু্যর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন, জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। তবে বারবার ব্যর্থ হয়েও চক্রান্তকারী ও ঘাতকরা বসে নেই। বাংলাদেশ তথা বাঙালিবিরোধী যে শক্তি তারা একটি বিষয় জানে, বঙ্গবন্ধুকন্যা তার প্রতিশ্রুতির জায়গায় বড্ড অটল এবং তিনি তার করা প্রতিটি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও দেশের মানুষ তাকে এবং তার দলকে কোনোদিন প্রত্যাখ্যান করবে না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পর্দার অন্তরালে ঘসেটি বেগমের মতো যারা বহু চক্রান্েতর নীলনকশা এঁকেছেন বা আঁকছেন সেগুলোকে যদি সিনেমার মতো করে সাধারণ মানুষের সামনে দেখানো যেত, লোমহর্ষক সে দৃশ্যপট দেখে মানুষ শুধু রোমাঞ্চিতই হতো না, বেদনায় নীল হয়েও যেত। ২৫ জুন ২০২২, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সংগঠিত সর্ববৃহত্ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকে পরাজিত করে বিজয়কেতন ওড়ানোর দিন। সে বিজয়কেতন উড়েছে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার মহানায়ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে।
আরব্য রজনির ইতিহাসের মতো আমাদের নেত্রীর হাতেও একটি অদৃশ্য তবে মসৃণ ও ধারালো তরবারি আছে, সেটি দিয়ে তিনি বাংলাদেশবিরোধী সব ষড়যন্ত্রের জাল কেটে কেটে এগিয়ে চলেছেন দুর্বার গতিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে অন্যসব দেশে মার্টিন লুথার কিং, আব্রাহাম লিংকন, নেলসন ম্যান্ডেলার মতো গণতান্ত্রিক নায়কদের কথা যদি বারবার বলা হয় বা আওড়ানো হয়, তাহলে বাংলাদেশে আবহমান ভিনদেশি বীরত্বচর্চাকে পরিহার করে আমার আপনার সন্তানকে ঘুম পাড়ানোর সময়, খাওয়ানোর সময় বা চুলে বেণি বাঁধার সময় কেন বাঙালির বীরত্বগাথার কথা বলব না! তাই আমি আহ্বান জানাব, আসুন, আমরা আমাদের আগত-অনাগত নবপ্রজন্মকে বাঙালির গণতান্ত্রিক হিরোইজমের কথা বলি, যেখানে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যার কথা লেখা আছে স্বর্ণাক্ষরে।
আধুনিক অর্থনীতিতে Production Possibility Frontier (PPF) নামে একটি বহুলসিদ্ধ তত্ত্ব পড়ানো হয়। এ প্রসঙ্গটি আমি আমার বেশ কয়েকটি লেখায় আগেও উল্লেখ করেছি। কারণ আমাদের যাপিত জীবনে এটি খুবই প্রাসঙ্গিক। উৎপাদন সম্ভাবনা সীমারেখার মূল বক্তব্যসমূহের একটিতে বলা হয় যে, সাধারণত নতুন কোনো প্রযুক্তির উদ্ভাবন, যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে নতুন স্হলসীমার সম্প্রসারণের মাধ্যমে উৎপাদন-সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু আধুনিক অর্থনীতির কোথাও এ কথা বলা হয়নি বা আলোচিত হয়নি যে, অনন্য নেতৃত্বের কারণে একটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন-সম্ভাবনা বাড়তে পারে। কিন্তু বাস্তবে সেটি হয়েছে, সেটি করে দিয়েছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। আজ দৃঢ়চিত্তে বলতে চাই, ২৬ জুন থেকে যে স্বপ্নের যাত্রা শুরু হলো, এতে আমাদের জিডিপি বেড়ে যাবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাবে, মানুষের আর্থসামাজিক সক্ষমতা বেড়ে যাবে।
শুধু তা-ই নয়, অতীতে ও বর্তমানে পদ্মা সেতুকে নিয়ে যারা ষড়যন্ত্র করেছেন, নিন্দা জানিয়েছেন, সমালোচনা করছেন, তারাও কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থের ক্ষেত্রে দলীয় এজেন্ডাকে পাশ কাটিয়ে পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক উদীয়মান অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে আঁকড়ে ধরেছেন আষ্টেপৃষ্ঠে। স্পষ্ট করে বললে, বিএনপি ও তাদের দুর্জন-মিত্ররা পদ্মা সেতুকে উপলক্ষ্য করে পদ্মার দুই পাশ ও সংযুক্ত অঞ্চলসমূহে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের দৌড়ে পিছিয়ে নেই, বরং অনেকের চেয়ে এগিয়ে আছেন। তারা জমি কিনছেন, প্রাইভেট হাউজিং সোসাইটি বানানো পরিকল্পনা করছেন, এছাড়া নানা রকম শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ার প্রস্ত্ততি নিচ্ছেন। তাদেরকে এসব কাজ দেখলে একটি কথা বলতে ইচ্ছে করে, সুবিধা নেওয়ার বেলায় ষোলো আনা, আর স্বীকার করার বেলায় শূন্য আনা। তাদের এসব কর্মকাণ্ড বাংলার মানুষ জানে না, তবে একদিন প্রকাশিত হবে নিশ্চয়।
২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ৯০ দিনের পেট্রোল-বোমার অগ্নিসন্ত্রাস যখন বাংলাদেশে বিরাজমান ছিল তখন তাদের সন্ত্রাসবাদী অবরোধের কারণে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ কর্মক্ষেত্রে যেতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু তাদের অনেক বড় পর্যায়ের নেতা ও সাবেক মন্ত্রীদের কথা আমরা জানি, যারা কিনা তাদের বস্ত্রনির্ভর ও রপ্তানিনির্ভর অন্যান্য ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান এক দিনের জন্যও বন্ধ রাখেননি, সেগুলো সম্পূর্ণরূপে সচল ছিল এবং অন্যদের চেয়ে বেশি মুনাফা করেছে। বেগম জিয়া তার দলের যে নেতা ও সাবেক মন্ত্রীর বাসায় বসবাস করেন এবং সেই সময়ে অগ্নিসন্ত্রাসের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই নেতাই পোশাক প্রস্ত্ততকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও রপ্তানি ব্যবসায় এক দিনের জন্যও বন্ধ রাখেননি এবং বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি লাভের দৌড়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ছিলেন তিনি। তাদের দুর্জন-জোটের নেতৃবৃন্দের দ্বৈতনীতি ও কর্ম। আজ বিএনপির ঐ সব নেতা শুধু মুখে মুখে পদ্মা সেতুকে ভূপেন হাজারিকা সেতুসহ বিভিন্ন সেতুর সঙ্গে তুলনা করেন, তারা পদ্মা সেতুর প্রাকৃতিক স্রোত-প্রবলতাকে মোকাবিলা করে অত্যাধুনিক ও বিশেষ প্রযুক্তির কর্মকৌশল ও উদ্যোগকে অস্বীকার করেন। আর বিবেক ও বুদ্ধি দিয়ে পদ্মা সেতুর প্রাসঙ্গিকতা ও সম্ভাবতাকে বিবেচনা করে উপর্যুপরি বিনিয়োগ করছেন পদ্মা সেতুর চারপাশে।
যাহোক, সব ষড়যন্ত্র ও সংকটকে পরাজিত করে পদ্মা সেতু আজ প্রজ্বলিত বাস্তবতা। এটি একটি ক্যারিশম্যাটিক ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট। এটি ভিশনারি লিডারশিপের ফল। আজ বিশ্ব যেমন বুঝে গেছে বাঙালির সক্ষমতা, আগামী দিনেও বুঝিয়ে দেব আমাদের আত্মনির্ভরতা। বঙ্গবন্ধু ও তার সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য, অনন্য ও অসাধারণ।
লেখক: কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ