শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

একজন মহিউদ্দিন আহমেদ

আপডেট : ৩০ জুন ২০২২, ০৯:৫৪

আড্ডাপ্রিয়। অকপট। বঙ্গবন্ধু ভক্ত। নিখাদ দেশপ্রেমিক। হৃদয়বিত্তে ঐশ্বর্যময়, আত্মপরতার ঊর্ধ্বে একজন নিরেট সত্মানুষ ছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ। সত্য বলার সাহস ও দৃঢ়তায় তিনি ছিলেন সর্বদা অবিচল। জানাশোনার পরিধিও ছিল বহুধাবিস্তৃত। নিরাপস ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। অসাম্প্রদায়িক, নিরহংকার একজন মুক্তচিন্তার মানুষ ছিলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করে ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে সরকারি বৃত্তি নিয়ে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে নবিস (তৃতীয় সচিব) কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেওয়ার পূর্বে তিনি ফেনী কলেজে দুই বছর শিক্ষকতা করেন।

লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে একজন প্রবেশনারি ফরেন সার্ভিস অফিসার হিসাবে তিনি ছয় দফার ওপরে ইংরেজিতে এক ঘণ্টার যে বক্তব্য রাখেন, তাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথাও তুলে ধরেন। তখন তাদের কোর্সে সিএসপি এবং পিএফসি (পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস)-এর ৩৫ জন কর্মকর্তার প্রত্যেককে ১০০ নম্বরের জন্য এক ঘণ্টার একটি বক্তৃতা দিতে হতো তার পছন্দের বিষয়ের ওপর। মহিউদ্দিন আহমদ তার বক্তব্যর বিষয় বেছে নিলেন ছয় দফা। সেই বক্তব্য দিয়ে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং অনেক বাঙালি অফিসারের প্রশংসাধন্য হন।

লাহোর ও ইসলামাবাদে শিক্ষানবিশ হিসেবে দুই বছরের প্রশিক্ষণ শেষে পোস্টিং ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে তৃতীয় সচিব হিসেবে লন্ডনে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুতে তিনি দ্বিতীয় সচিবে পদোন্নতি পান। এরপর সদ্যপ্রতিষ্ঠিত লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনেও তিনি দ্বিতীয় সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি দিল্লি, জেনেভা ও ঢাকা এবং এরপর জাকার্তা, জেদ্দা হয়ে আবার ঢাকায়। তারপর ১৯৯১-৯২-তে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে ভারপ্রাপ্ত স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে চাকরি করেন। তবে তিনি ঢাকায় অবস্থানকালে সেনাশাসক জেনারেল এরশাদ এবং তার সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর কোপানলে পড়েন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাকে তিন বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠায় কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ে।

মহিউদ্দিন আহমেদই একমাত্র বাঙালি কূটনীতিক, যিনি পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিবের পদত্যাগ করে সমগ্র ইউরোপে প্রথম বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারের স্মরণকালের বৃহত্তর সমাবেশে। মহিউদ্দিন আহমদ রেখে গেছেন স্ত্রী ও দুই মেয়ে—অরু ও লরা। লিভারেশন বেবি হিসেবে বর্ণিত—অরুর জন্ম লন্ডনে ’৭১ সালে, তার চাকরি ছাড়ার তিন সপ্তাহ পরে। লরার জন্ম ১৯৭৮-এ। এখানে বলা প্রাসঙ্গিক যে, মহিউদ্দিন আহমদ চাকরি ত্যাগ করে লন্ডনপ্রবাসী মুক্তিসংগ্রামী তরুণ সমাজের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহায়তা লাভ করেন এবং নন্দিত হন। যদিও তিনি তখন সদ্যপিতৃত্ব লাভ করতে যাচ্ছেন এবং এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াচ্ছেন।

১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারের সময়, তিনি যখন জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশনের উপপ্রধান, তখন বিএনপির এমপি জিয়াউল হক জিয়া মিশনে তার রুমে বঙ্গবন্ধুর ও বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে একত্রে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার ছবি দেখে দেশে ফিরে খালেদা জিয়ার কাছে নালিশ জানালে, খালেদা জিয়া আট মাসের মাথায়ই তাকে মিশন থেকে ফিরিয়ে এনে বাধ্যতামূলক চাকরি থেকে অবসরে পাঠান। এর বিরুদ্ধে তিনি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করে জিতে চাকরিতে পুনর্বহাল হন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে তিন মাসের মধ্যে তাকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সব সুযোগ-সুবিধা ও সিনিয়রিটিসহ সম্মানের সঙ্গে চাকরিতে ফিরিয়ে নেন ।

পরে তার অতিরিক্ত পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে পদোন্নতি হয় ও ২০-২৫ বার ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব পালন এবং সবশেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমির অধ্যক্ষ হিসেবে ২০০১ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

মহিউদ্দিন আহমদের জন্ম ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার নূরপুর গ্রামে ১৯ জুন, ১৯৪২ সালে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে তিনি বড় হয়েছেন। তাদের গ্রামের তিন দিকেই ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরা। তার পিতা আবদুর রশিদ মাস্টার ছিলেন একটি মাইনর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। তার মা একজন রত্নগর্ভা। পাঁচ ভাই এক বোন ছিলেন তারা। বড় এবং মেজো—এ দুই ভাই এখন প্রয়াত।

২০ জুন, সোমবার, ২০২২ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সাদামাটা অনাড়ম্বর জীবনযাপনের এই মানুষটির প্রয়াণ ঘটে। তবে আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আমার সঙ্গে তার নদীপথে লঞ্চে করে বরিশালে যাওয়ার শখ অপূর্ণই রয়ে গেল! মহিউদ্দিন আহমদ এমন এক মহত্প্রাণ মানুষ ছিলেন, তার এলাকায় অন্তত ৩০টি অসচ্ছল পরিবারকে প্রতি মাসে তার পেনশন ও মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা সাহাঘ্য করতেন।

অবসরপ্রাপ্ত জীবনে তিনি কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লেখা শুরু করেন এবং স্বল্পসময়েই প্রভূত আলোচিত হয়ে ওঠেন। তার লেখা ছিল তথ্যবহুল। কারণ তিনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন। তার ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহ কয়েক হাজার। তার মধ্যে শুধু সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা নিয়ে তার সংগ্রহ বইয়ের সংখ্যাই হবে শতাধিক। পড়াশোনার বাইরে তিনি নিয়মিত বিবিসি শুনতেন। সিএনএন দেখতেন। খবর শোনা ও দেখা ছিল তার প্রাত্যহিক অভ্যাসের অংশ। অর্থাত্ দুনিয়ার কোথায় কখন কী হচ্ছে, সে সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। দুর্নীতি ও দুবৃ‌র্ত্ততাড়িত রাজনীতির তিনি ঘোরতর বিরোধিতা ও সমালোচনা করতেন।

লেখক: সাংবাদিক

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন