শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শত সংকটে সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যাদুর্গতরা

  • দীর্ঘ দিন পর রৌদ্রোজ্জ্বল সিলেট, বানভাসি মানুষের মনে স্বস্তি
  • ১০ দিনের মধ্যে বন্যার পানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছে না পানি উন্নয়ন বোর্ড
  • গরু ছাগল নিয়ে বিপাকে, গোখদ্যের তীব্র সংকট
আপডেট : ০২ জুলাই ২০২২, ১৯:১৩

সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত এলাকার অধিবাসীরা শত সংকটে এখন দিন পার করছেন। কারো বাড়ি নেই, ঘর নেই। ঘর আছে তো গৃহস্থলীর জিনিস নেই। গরু নেই। আবার গরু আছে তো গো-খাদ্য নেই। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে খাদ্য  বিতরণের চিত্র্রও অভাবনীয়। তারপরও সংকট আর দুর্ভোগের যেনো শেষ নেই। 

এদিকে রৌদ্রোজ্জ্বল সিলেটের বানভাসি মানুষের মনে অনেকটাই স্বস্তি ফিরে আসে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলেছে, নদীর পানি ধীরে হলেও কমছে। বৃষ্টি ও ঢল কমেছে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা তারা দেখছেন না। এদিকে উপদ্রুত এলাকায়, বন্যার তাণ্ডবে তছনছ হয়ে যাওয়া অবশিষ্ট মাল-সামানা শনিবার কড়া রোদে শুকাতে দেখা যায়। জীবন বাজি রেখে যক্ষের মত আকড়ে রাখা কিছু ভিজা ধান, কাতা-বালিশ গৃহিনীরা চালের ওপর ও ভেসে উঠা সড়কে শুকাতে দেখা যায়। তারপরও তাদের চোখে মুখে বিষাদের ছায়া লেগে আছে। বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জবাসীর জন্য যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তা কবে কোন বছর মোচন হবে তা তারা জানেন না। গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে এখন এই জনপদের অসহায় মানুষের জীবন।

সিলেট বিভাগের ৬৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত

সরকারি হিসাবেই এবারের বন্যায় সিলেট বিভাগের সোয়া কোটি মানুষের মধ্যে ৬৩ লাখ ৪৫ হাজার ৬৬৫ জন ক্ষতিগ্রস্ত হন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে সংখ্যা ৬ লাখ ২২ হাজার ৯৮৬টি। সরকারি তথ্য মতে সুনামগঞ্জে সবচাইতে বেশি ৩০ লাখ ও সিলেট জেলা ও মহানগরসহ ২৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪৪৩ জন, মৌলভীবাজারে ২ লাখ ৬২ হাজার ৭৩৬ জন, হবিগঞ্জে ৮৩ হাজার ৪৯০ জন। এর মধ্যে বহু প্রতিবন্ধী শিশু, নারী ও বৃদ্ধ রয়েছেন। চাল-চুলা হারিয়ে অন্তত সোয়া লাখ লোক এখন নি:স্ব- অসহায়। প্রশাসনের হিসাবেই সিলেটে ও সুনামগঞ্জে ৮৫ লাখ লোকের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বেশিরভাগ এলাকা এখনো জলমগ্ন

সিলেট নগরীর বাইরের বেশিরভাগ এলাকাই জলমগ্ন। ১৭ দিন ধরে পানিবন্দি থাকা মানুষের দুর্ভোগ সীমা ছাড়িয়েছে। ভয়াবহ বন্যায় মোকাবেলা করছেন পুরো সিলেটবাসী। বিভাগের মধ্যে সিলেট নগরী ও জেলার ৮০ ভাগ এবং সুনামগঞ্জের ৯০ ভাগের ওপরে এলাকা প্লাবিত হয়। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চলও প্লাবিত হয়েছে। উপদ্রুত এলাকায় মানবিক বিপর্যয় চলছে। বন্যা অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, গবাদিপশু-হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, ঘরের আসবাবপত্র ভেসে গেছে বানের পানিতে। সুনামগঞ্জে কবর দেওয়ার মত মাঠিও রক্ষা পায়নি বন্যা থেকে। বানভাসি লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নেন।

বিশুদ্ধ পানির সংকট

গত ১৫ জুন থেকে চেরাপুঞ্জির ভারি বর্ষণ ও মেঘালয় থেকে নেমে আসা ঢলে পরদিন থেকে অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে বন্যার পানি। ভারি বর্ষণ বন্যায় বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রগুলোতে পানি উঠার ফলে সিলেট নগরী সহ প্রত্যন্ত এলাকার মানুষও বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েন। টিউবওয়েলগুলো পানিতে তলিয়ে যায়। চারদিকে পানিতে থৈ থৈ করলেও খাবার পানির তীব্র সংকট চলছে। যদিও স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনগুলো ও ব্যক্তি উদ্যোগে বানভাসিদের খাবার ও পানি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চাহিদা পূরণ হচ্ছেনা। সিলেট ও সুনামগঞ্জে ৮০ ভাগ নলকূপ পানিতে তলিয়ে যায়। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে ২০ ভাগ নলকূপ পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। সরকারি হিসাবের বাইরে ব্যক্তি কেন্দ্রিক বসানো অন্তত ৫০ হাজারের বেশি নলকূপ সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুহাম্মদ শেখ সাদি রহমত উল্লাহ বলেন, বিভাগে সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেওয়া ৪৯ হাজার ১১০টি নলকূপ বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। যার পরিমাণ ৮০ ভাগ হবে। এরমধ্যে সিলেট জেলায় ২০ হাজার ২৩৪টি, সুনামগঞ্জে ২৭ হাজার, হবিগঞ্জে ১ হাজার ৫৯১ টি এবং মৌলভীবাজারে ২৮৫টি। এর বাইরে ব্যক্তি কেন্দ্রিক ৫ গুন নলকূপ রয়েছে। এসব নলকূপের অন্তত ৫০ হাজার বন্যায় প্লাবিত হতে পারে।

তিনি বলেন, বিভাগের বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে ২৬ লাখ ৬ হাজার ৪০০ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। এরমধ্যে সিলেট জেলায় ১১ লাখ ৭৮ হাজার, সুনামগঞ্জে ১৩ লাখ, হবিগঞ্জে ১ লাখ ১ হাজার এবং মৌলভীবাজারে ৮৫ হাজার। এর বাইরেও ১৩টি মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট সরবরাহ করা হয়। সিলেট ও সুনামগঞ্জে ৫টি করে। ১টি নগরীতে ২টি রিজার্ভে রাখা হয়েছে। এছাড়া বন্যা কবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি মজুত রাখতে ১২ হাজার ১৫১টি জারিকেন বিতরণ করা হয়। এরমধ্যে সিলেট জেলায় ৭ হাজার ৭১টি, সুনামগঞ্জে ৫ হাজার, হবিগঞ্জে ১১২ ও মৌলভীবাজারে ৮০টি।

সিলেট জেলায় ২৭ হাজার নলকূপ বন্যার পানিতে

জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আলমগীর হোসেন বলেন, সিলেট জেলার ১৩টি উপজেলার ৯৯ টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। জেলায় ৩৫ হাজার নলকূপের মধ্যে ২৭ হাজার বন্যার পানিতে তলিয়েছে। আর বেসরকারি প্রায় ২ হাজার নলকূপ প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া ৮টি মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি  থেকে অন্তত ৫ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করা যায়। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, বিশ্বনাথ, ফেঞ্চুগঞ্জে এবং নগর এলাকায় একটি করে মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট দেওয়া হয়েছে। আর ২টি রিজার্ভ রাখা হয়েছে। পানি কমলে নলকূপের পানি কিভাবে বিশুদ্ধ করা যায়, সেই পদ্ধতি জানাতে প্রচারণা চলছে।

গোখাদ্যের তীব্র অভাব

হাওরাঞ্চালে বেচে থাকা গবাদিপশু নিয়ে এখন মহা বিপদে আছেন কৃষকরা। বন্যার পানিতে ঘর তলিয়ে গেছে। বহু কষ্টে আশ্রয় কেন্দ্র উঠেছেন তারা। বানের পানি বহু কৃষকের খাড় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এখন খাবার ও চিকিৎসা না পেলে গরুগুলোকে বিক্রি করতে হবে-এরকমই জানালেন কৃষকেরা। অনেকেই পরিবার পরিজন ও গরু-ছাগল নিয়ে আশ্রয়ে আছেন বড় কোন সড়কে। খাবারের অভাবে গরুগুলো দুর্বল হয়ে পরেছে। নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যথাযথ চিকিৎসকও হচ্ছেনা। উপজেলার টাংগুয়ার হাওর, মাটিয়ান, শনিসহ বিভিন্ন হাওর পাড়ের বাসিন্দাদের বন্যায় সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে হাওর পাড়ের কৃষক পরিবারগুলোর। তারা পরিবার পরিজন ও গরু, ছাগল নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উঁচু বাড়ি ঘর ও সেতুতে। তারা বন্যায় গরু-ছাগল,হাঁস-মুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন প্রায় সবাই। কোনো রকমে আশ্রয় কেন্দ্রে ও কিছু মানুষ নিজ বাড়িতে রেখে কোনোভাবে এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। টাকা-পয়সাও নাই। খাবার আনতে পারছে না। তারা বলেন, এই মুহূর্তে গরুর জন্য খড় জোগাড় করাটা অসম্ভব একটি কাজ। খড়ের গাদাই ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। 

ইত্তেফাক/জেডএইচডি