শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চীনে সাইবার নজরদারি কি নেটিজেনদের জন্য হুমকি

আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২২, ১৬:১৫

বিশ্বজুড়ে এখন ইন্টারনেটের সোশাল মিডিয়ার দোর্দণ্ড প্রতাপ। এমন অবস্থায় নেটিজেনদের এসব মাধ্যম ব্যবহারে রাশ টানতে নিয়ন্ত্রণ মূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে, যাকে বলা হচ্ছে ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ। 

বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট। এসব আন্দোলনে অনেক পরিবর্তন এলেও বিশেষত, বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীনরা সোশাল মিডিয়ায় বিক্ষোভ-বিপ্লব নিয়ে খুশি ছিলনা।

স্বাভাবিকভাবেই সরকারগুলো ডিজিটাল মিডিয়ায় তথ্যের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে দমনমূলক আইন বাস্তবায়ন শুরু করে। বিশেষ করে চীন যেভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গণনজরদারি এবং সেন্সরশিপ নীতি প্রয়োগ করছে, তা অনেক সরকারের কাছে অনুকরনীয় হয়ে উঠছে। চীনে সোশাল মিডিয়াগুলোর জন্য পরিবর্তিত নীতিই প্রমাণ করে তারা কতটা শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে ডিজিটাল বিশ্ব।

চীনের বৃহত্তম মাইক্রোব্লগিং ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ ওয়েইবো, এমন একটি ফিচার চালু করেছে যা সাইট ব্যবহারকারীদের অবস্থান প্রদর্শন করবে। পোস্ট দেওয়া ব্যক্তির ইন্টারনেট প্রোটোকল  (আইপি) অবস্থান প্রকাশ্যে প্রদর্শিত হবে। শুধুমাত্র ওয়েই বোনয়, অন্যান্য মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন যেমন কুয়াইশো, শিয়াওহয়সু, জিনরিতুতিয়াও এর মত অ্যাপ্লিকেশনগুলোও একই পরিকিল্পনা  নিয়েছে। 

সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো বলছে, ভুয়াখবর, গুজব এড়াতে একটি সুস্থ পরিবেশ দিতে এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু ব্যবহারকারীদের রয়েছে এ নিয়ে উদ্বেগ। বিশেষ করে, গোপনীয়তা রক্ষা না হওয়ার বিষয়টি সবার আগে আসে এবং ডিজিটাল নজরদারি ভালো করেই বোঝাচ্ছে যে, সরকারের সেন্সর শিপের মধ্যে রয়েছে লুকানো এজেন্ডা, যার অন্যতম নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল ।

ফেসবুক, টুইটার এবং সার্চ ইঞ্জিন গুগলের মতো কিছু জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম একদশকেরও বেশি সময় ধরে চীনে নিষিদ্ধ। এসব কোম্পানি সম্পর্কে কোনো ধারণা ছাড়াই বেড়ে উঠছে দেশটির নতুন প্রজন্ম।  

সাইবার নজরদারি কর্তৃপক্ষের কঠোরতার মধ্যেই এমন প্ল্যাটফর্মগুলো চীনে আবির্ভূত হচ্ছে। যেভাবেই কাজ করুক না কেন, তাদের যা করতে হবে তাহল বেইজিং কর্তৃক অনুমোদিত সেন্সরকৃত বিষয় বস্তু প্রকাশ করা। আর যখন ইইন্টারনেট সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি আসে, তখন মনে হয় নাগরিকদের ঝুঁকি নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিতে হবে। 

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদন অনুসারে, চীনে টানা সাত বছর ধরে ইন্টারনেট স্বাধীনতার সবচেয়ে খারাপ অপব্যবহার করা হচ্ছে।  

প্রতিবেদনে ইন্টারনেটের স্বাধীনতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে প্রধানত তিনটি সূচকে। এগুলো হলো- বিষয় বস্তুর সীমাবদ্ধতা, ব্যবহারকারীর অধিকার সুরক্ষা এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা।

বছরের পর বছর ধরে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি নেটিজেনদের অধিকার দমন করে আসছিল এবং মত প্রকাশের স্বাধীন তাকে মূল্য না দিয়ে এটি অব্যাহত ভাবে চলেছে। 

ব্যবহারকারীদের অবস্থান শনাক্ত করণের এই ব্যবস্থা কোনো ব্যক্তি কে বিদেশিদের পক্ষ নেওয়া বিশ্বাস ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ করে দিতে পারে চীনা সরকারকে। যেসব চীনা নাগরিক কর্তৃপক্ষের অদ্ভুত নীতির বিরুদ্ধে কথা বলবেন তাদের বিশ্বাস ঘাতক হিসেবে গণ্য করা হবে। 

জাপানে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া চীনা বুদ্ধিজীবীদের একটি দলকেও‘ বিশ্বাসঘাতক’ বলা হয়েছিল। এই ঘটনাটিই প্রমাণ করে সরকার কীভাবে তাদের নাগরিকদের চরমপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করতে উঠে পড়েলে গেছে। অনেক নেটিজেনের মতে, এই নীতিটি দেশপ্রেমিক নেতাদের অবস্থান খুঁজে বের করার উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু করা হয়েছে যাতে সরকার তাদের প্রকৃত দেশ প্রেম এবং জনগণের প্রতি তাদের বিশ্বস্ত তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে।

‘ওয়েইবো, তে এমন একদল লোক রয়েছে যারা অ্যাকাউন্ট এবং বার্তাগুলো মুছে ফেলার কাজ করে। বিশেষ করে সেই অ্যাকাউন্ট এবং বার্তাগুলো যদি সরকারের দেওয়াশর্ত ভঙ্গ করে।

একটি প্রতিবেদন অনুসারে চীনা সরকার আন্তর্জাতিক বাহিনী এবং স্থানীয় বিভাগের সহায়তায় সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক নজরদারি একটি নেটওয়ার্ক তৈরির লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, তথ্য নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি তৈরিতে কীভাবে চীনা পুলিশ, মিডিয়া এবং সাইবার নিয়ন্ত্রণকারীরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) সর্বদাতাদের নজরদারি কৌশল গুলোর জন্য পরিচিত, যা তাদের নাগরিকদের মৌলিক গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করে।

একমাত্র পরিবর্তন যা হতে পারে সেটি হলো- জনগণের ওপর গুপ্তচরবৃত্তির পদ্ধতি বদল। আগে যদি ‘শার্প আইজ’ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যাপক নজরদারি করা হত, তবে এখন সেটি প্রযুক্তিগত অনুপ্রবেশ।

প্রস্তাবিত‘ অবস্থান ট্র্যাকিং’ সরকারের একটি সম্ভাব্য নজরদারি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।

চীনে নাগরিকদের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতা নেই বললেই চলে। সরকার সোশাল মিডিয়াতে প্রতিটি পোস্ট এবং বিষয়বস্তু সেন্সরশিপকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিচ্ছে। দুর্দান্ত ফায়ার ওয়াল নেটিজেনদের কাছে একটি বড় ধান্দবাজির গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের অবস্থান প্রদর্শন তাদের জন্য বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। 

যদিও এই পদ্ধতিতে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট ডিভাইসের ভৌগলিক অবস্থান নিশ্চিত করা যাবে, তারপরও চীনা সাইবারস্পেস ব্যক্তির আসল অবস্থান শনাক্ত করার একটি উপায় পেতে পারে।  

চীনা সরকার এবং সোশাল মিডিয়াগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করে নাগরিকদের গোপনীয়তার জন্য উচ্চ প্রযুক্তির পদ্ধতিগুলি চাপিয়ে দিচ্ছে।

ইত্তেফাক/টিআর