শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ফ্যামিলি প্ল্যানিং যে সমস্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে 

আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২২, ০২:২৮

এক সময়ের নিন্দিত বাংলাদেশ এখন নন্দিত। এ দেশের বিস্ময়কর অগ্রযাত্রার প্রশংসা করছে সমগ্র দুনিয়া। ৫০ থেকে ৮০-র দশকের সময় এ দেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থায়ও প্রতি দম্পতি ১০-১২টি করে সন্তান জন্মদান করত। এ কারণে মাতৃমৃত্যু-শিশুমৃত্যু ছিল খুব বেশি। নারী শিক্ষার হার কম থাকায় ১২-১৪ বছরের মধ্যে বিয়ে হয়ে যেত। এমন অবস্থা এখন দেশে নেই। মূলত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে অর্থনীতির সাফল্য অর্জন করেছে এ দেশ। বাঙালি নোবেলবিজয়ী অমর্ত্য সেন, জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, স্যানিটেশন, সামাজিক উন্নয়ন, টিকাদান কর্মসূচির ভূয়সী প্রশংসা করছেন। পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকা বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সাফল্যের প্রশংসা করে এ পথ অনুসরণ করতে পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ করেছে।

১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সাহাঘ্যের জন্য আমেরিকায় গিয়েছিলেন। তখন তাকে বলা হয়েছিল, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করলে সাহাঘ্য দেওয়া যাবে না। তখন ১৯৬০সালে থানা পর্যায়ে একজন পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও একজন অফিস সহকারী নিয়োগ দিয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক প্রচারণা শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার ৫৫ হাজার বর্গমাইল এলাকায় প্রতি বছর ৩০ লাখ করে লোক বাড়লে ২৫-৩০ বছরে বাংলায় কোনো কৃষিজমি থাকবে না। সেজন্য ‘পপুলেশন কন্ট্রোল ফ্যামিলি প্ল্যানিং’ করতে হবে। ১৯৭৬ সালে ইউনিয়ন Family Welfare Assistant (FWA) এবং তাদের তদারকি ও সহায়তার জন্য একজন পুরুষ কর্মচারী Family Planning Assitant (FPA) নিয়োগ দেওয়া হয়। এভাবে ইউনিয়নে একজন করে Family Planning Visitor (FPV), Medical Assitant (MA) ও Pharmacist নিয়োগ দেওয়া হয়। এ কর্মচারীরা এ দেশের গ্রামাঞ্চলের গরিব অসহায় জনগোষ্ঠীকে যুগ যুগ ধরে সেবা প্রদান করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছেন। FWA দম্পতি, রেজিস্ট্রেশন জনসংখ্যাসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে মা, শিশু, কিশোর-কিশোরীদেরসহ সব ধরনের গণসচেতনামূলক কাজ কর্ম করছেন এবং বর্তমানে এ কর্মচারীরাই রেজিস্ট্রারের কাজ করছেন। এ কর্মচারীরা এক সময় সামাজিক ও ধর্মীয় বাধার কারণে অনেকেই মারপিট খেয়েছেন, পরিবারকে সমাজচ্যুত করা হয়েছে, এমনকি মৃত্যুর পর জানাজায়ও বাধা-আপত্তি করা হতো। কর্মচারীরা স্থানীয় থাকায় সব বাধা অতিক্রম করে বৈপ্লবিক ভূমিকায় জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখিয়েছেন। একসময় FPA পদকে FPI এবং MAপদ SACMO পরিবর্তন করা হয়।

১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে স্বাস্থ্য বিভাগ ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডে একজন করে Health Assistant (HA) নিয়োগ দেয়। এদের মধ্যে অধিকাংশ কর্মচারী ছিলেন পুরুষ। ফলে পুরুষ কর্মী দিয়ে টিকা দেওয়ায় নারীরা টিকা কেন্দ্রে উপস্হিত হতো না। এক পর্যায়ে FWAদের সংযুক্ত করার পর থেকে দেশের টিকা কেন্দ্রগুলোতে নারী ও শিশুদের উপচে পড়া ভিড় জমে থাকত। এভাবে ইপিআই টিকাদান সফলতা অর্জন করে। টিকাদানের সুযোগে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ দ্রব্যাদি বিতরণ করায় ফ্যামিলি প্ল্যানিং কর্মচারীরা স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে বহুল পরিচিতি পান। ইপিআই টিকাদান সফলভাবে বাস্তবায়িত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভ্যাকসিন হিরো উপাধিতে ভূষিত করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে FWA, FWV গণ-নরমাল ডেলিভারির কাজও করছেন। হাসপাতালে ক্লিনিকে যখন সিজারিয়ান ডেলিভারির রমরমা ব্যবসা হচ্ছে, তখন FWA, FWV-রা বিনা মূল্যে নরমাল ডেলিভারি করে দেশে এক নজির স্থাপন করেছেন। বর্তমানে সারা দেশে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার (সিএসবিএ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) FWA ও FWV ডেলিভারি কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এতে দেশে মাতৃমৃত্যু-শিশুমৃত্যু কমে যাচ্ছে। কর্মচারীদের অভিযোগ রহস্যজনক কারণে সিএসবিএ প্রশিক্ষণ বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে আগ্রহী FWA প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। ১৮৬০ সালে পূর্ব বাংলায় জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২ কোটি। ৭১ সালে ছিল সাড়ে ৭ কোটি। পরিসংখ্যান বু্যরোর ২০২০ সালের হিসাব মতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৮২ লাখ। ২০৫০ সালে আমাদের জনসংখ্যা ২২ কোটি হওয়ার কথা। ৭৫ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৬ ধশমিক ৩৪, ২০১১ সালে কমে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৩ ভাগ। ১৯৭১-২০১১ পর্যন্ত সময়ে গড়ে দম্পতির চার সন্তান করে কমেছে। বর্তমানে অধিকাংশ দম্পতির দুই সন্তানের বেশি দেখা যায় না। তবে বস্তি এলাকায় কিছু বেশি দেখা যায়। ৭১ সালে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৬ কোটি। ২০২২ সালে এসে দাঁড়ায় ২২ কোটি। ৫২ বছরে বেড়েছে ১৫কোটি। ৭১-২০২০ সাল সময়ে আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৯ কোটি ৩২ লাখ।

স্বাধীনতার পর বিভিন্ন বিভাগের উন্নয়ন খাতের কর্মচারীদের রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা হয়। ২০০৫ সালের ২০ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারিকৃত এক পরিপত্রে বলা হয়েছে—১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত উন্নয়ন খাত থেকে রাজস্ব খাতের স্থানান্তরিত কর্মকর্তা কর্মচারীদের চাকরিকাল যোগদানের তারিখ থেকে গণনা করা হবে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় এ পরিপত্র অমান্য করে ২০ শতাংশ পেনশন কর্তনের জন্য দুইটি পত্র জারি করে। পত্র দুইটির বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে রিটপিটিশন নম্বর ৮৯৩৮-২০১১ দায়ের করা হয়। রিটপিশনকারী হচ্ছেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ডাটা এন্ট্রি কন্ট্রোল ঢাকার অপারেটর মো. নজরুল ইসলামসহ চার জন। মহামান্য হাইকোর্ট পত্র দুইটি বাতিল করেন। কিন্তু মন্ত্রণালয় মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশটি যথাযথভাবে অনুসরণ না করায় কর্মচারীদের পেনশন জটিলতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। কেউ কেউ পেনশন উত্তোলন করতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। তাদের বোবাকান্না কেউ শুনছে না। ১৯৯৬ ও ২০১৫ সালে দুইটি নিয়োগ বিধি প্রণয়ন করা হলে ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের মাঠ কর্মচারীদের নিয়োগবিধিতে অন্তভু‌র্ক্ত না করায় সারা জীবন একই পদে চাকরি করতে হয়। তাদের প্রমোশন ও গ্রেড পরিবর্তন হচ্ছে না। অথচ এসব পদে নিয়োগ হচ্ছে। উপজেলা অফিস সহকারীগণ ৯৬ সালের নিয়োগবিধিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তারা উপজেলা ও জেলা অফিসার হিসেবে পদোন্নতি পাচ্ছেন। একসময় FWA ও FPI প্রায় ৬০ হাজার কর্মচারী থাকলে এখন আছেন প্রায় ২৫-২৬ হাজার। ১৯৭৭-৮৫ সালে FWA ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক ৪০০ টাকা বেতন স্কেলে এবং FPI ও প্রধান শিক্ষক ৪৩০ টাকা বেতন স্কেলে সমান পদমর্যাদার চাকরিতে ছিলেন। কিন্তু শিক্ষকদের অবস্থার পরিবর্তন হলেও এসব কর্মচারীদের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কৃষি, মত্স্য, এলজিইডিসহ বিভিন্ন বিভাগের কর্মচারীদের সঙ্গে বেতনবৈষম্য থাকায় চরম হতাশা বিরাজ করছে।

খুলনার মাতারবাড়ী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কেন্দ্রের FWA সুলতানা বেগম জানালেন, গত বছর তিনি ৭০০ এবং চলতি বছর ছয় মাসে ৩০০ নরমাল ডেলিভারি করেছেন। তিনি বলেন, ‘দিবানিশি দেশের মানুষের জন্য কাজ করছি। কিন্তু নিয়োগবিধি না হওয়ায় প্রমোশনও গ্রেড পরিবর্তন হচ্ছে না। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার এনায়েতপুর ঋডঈ তে কর্মরত FWA হাজেরা বেগম জানালেন, ডাক্তাররা যে ডেলিভারি করেন, সেই কাজটি আমরাও করছি। কিন্তু আমাদের নিয়োগবিধি নেই, প্রমোশন ও গ্রেড পরিবর্তন হচ্ছে না। বরং পেনশনের সময় ২০ শতাংশ টাকা কর্তন করে রাখা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নিকট আমাদের কাজের মূল্যায়ন চাই।’ তিনি প্রতি মাসে গড়ে ৫০-৬০টি করে ডেলিভারি করেন বলে জানান। হবিগঞ্জ সদরের পইল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে কর্মরত FWV নুরজাহান বেগম জানালেন, ‘প্রতি ইউনিয়নে একজন FWV দিনে রাতে ডেলিভারিসহ মানুষের সেবা করতে হচ্ছে। নিয়োগবিধি, প্রমোশন ও গ্রেড পরিবর্তন চাই আমরা।’ সুনামগঞ্জের পশ্চিম পাগলা ঋডঈতে কর্মরত FWV শাহিনা আক্তার বলেন, ডেলিভারি ও স্যাটেলাইট ক্লিনিকের মাধ্যমে সেবা দেওয়ার পরও বলা হয়, ডাক্তার, নার্স ও মিডওয়াইফরা ডেলিভারি করে থাকেন। কাজ করি আমরা, প্রশংসা পায় অন্য বিভাগ।’ তিনি অবিলম্বে নিয়োগবিধি বাস্তবায়নের দাবি জানান। FWA ও FPI সমিতির সিলেটের নেতা রাশেদা খানম রিনা বলেন, মন্ত্রী, এমপি, সচিব ও অধিদপ্তরসহ সব মহলে আবেদন-নিবেদন ঢাকায় মানব বন্ধন করেছি। কিন্তু দাবি লাল ফিতায় আটকে আছে।’ তিনি প্রধানমন্ত্রীর নিকট পেনশনের ২০ শতাংশ কর্তন বাতিল এবং নিয়োগবিধি সম্পন্ন করে প্রমোশন, গ্রেড পরিবর্তনের জোর দাবি জানান।

পৃথিবীর উন্নত অনুন্নত অনেক দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আলাদা মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী, সচিব থাকায় সে দেশে কর্মকর্তা কর্মচারীদের সর্বোচ্চ মান-মযা‌র্দা ও আর্থিক সুবিধাদি পেয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ফ্যামিলি প্ল্যানিং অধিদপ্তরের কর্মচারীরা স্বাস্থ্যকর্মীর পরিচয়ে কাজ করছেন। তাদের জীবনের কোনো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি বিবেচনা করলে বিশাল একটি সেবা প্রদানকারী গোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান হতে পারে।

লেখক: লেখক ও সমাজ বিশ্লেষক, সিলেট

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন