শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

গোবেচারা গরু ও তারকা গরু

আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২২, ০২:৩৬

গরু নিরীহ হলেও আলোচিত একটি প্রাণী। কোরবানির ঈদ এলে গরুর দাম ও কদর কয়েক গুণ বেড়ে যায়। কেমন গরু কোরবানি করা হবে, সেই গরু কোত্থেকে সংগ্রহ করা হবে, তার দাম কী রকম হবে, সেই টাকা কোথা থেকে আসবে, এককভাবে কোরবানি দেওয়া হবে, নাকি ভাগে দেওয়া হবে, কোরবানির পশুর হাটে গিয়ে গরু কেনা হবে, না অনলাইনে কেনা হবে— এসব নিয়ে এখন বাংলার ঘরে ঘরে আলোচনা, গবেষণা। আসলে কোরবানির ঈদ এলে বোঝা যায় গরু কতটা উপকারী প্রাণী এবং এর গুরুত্ব কত।

কোরবানির ঈদে আমাদের দেশের কিছু কিছু গরু রীতিমতো ‘তারকা’র মর্যাদা পায়। তাদের নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। নিজের প্রিয় গরুগুলোকে খামারিরা আদর করে বিভিন্ন নাম দিয়ে থাকেন। বাহারি সব নামের বিশালাকার এসব গরু হাটে আসা ক্রেতাদের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকে। অনেক ক্রেতাই কোরবানির জন্য এমন বাহারি নামের গরু কেনেন।

এ বছরের কয়েকটি ‘তারকা’ গরুর কথা ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। আলোচিত গরুগুলোর একটি হচ্ছে ‘বাদশা’। লাল-সাদা রঙের মিশ্রণের মোটাতাজা এই গরুটির হাবভাব, হম্বিতম্বি ঠিক রাজা-বাদশাদের মতোই। অপরিচিত কেউ কাছে ঘেঁষলেই মাথা নাড়ছে সে। নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস আওয়াজ করছে। ভাবটা এমন, সুযোগ পেলেই যেন সজোরে গুঁতা দিয়ে দেবে। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে গরুটি তোলা হয়েছে রাজধানীর গাবতলীর পশুর হাটে। পাবনার সদর থানার দুবলিয়া এলাকার কৃষক মো. ফিরোজ মিয়া বাদশাকে হাটে এনেছেন। ফ্রিজিয়ান ক্রস জাতের বাদশার ওজন প্রায় ১ হাজার ৩০০ কেজি। নিজের পালিত গাভি থেকেই এর জন্ম, বয়স চার বছর। এর দাম হাঁকা হয়েছে ১৭ লাখ টাকা।

আরেক গরুর নাম ‘রাজাবাবু’। পুরোটাই কালো রঙের লোমে আবৃত বিশালাকার এই গরু। খামারি ভাষাণ মিয়া গরুটি এনেছেন মেহেরপুরের গাংনী থেকে। রাজাবাবু ফ্রিজিয়ান ক্রস জাতের গরু। ওজন প্রায় ১ হাজার ৪০০ কেজি বা ৩৫ মণ হবে। রাজাবাবুকে পালা হয়েছে গম-ভুট্টার ভুসি, ছোলা, খড় ও ঘাস খাইয়ে। প্রতিদিন তিন বেলা গোসল করানোর পাশাপাশি রাজাবাবুকে প্রাতঃভ্রমণ বা সান্ধ্যভ্রমণের মতো নিয়ম করে হাঁটানোও হতো। এর দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ লাখ টাকা।

তবে এ বছর কোরবানির হাটে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যশোরের ‘কালাপাহাড়’। ৫৫ মণ ওজনের ষাঁড়টির দাম হাঁকা হচ্ছে ৩০ লাখ টাকা। ইতিমধ্যে খুলনা বিভাগে সবচেয়ে বড় ষাঁড় হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছে।

আমাদের দেশে জনপ্রিয় তারকাদের নামেও গরুর নাম রাখার প্রচলন শুরু হয়েছে। গত বছর গরুর হাটে হিট ছিল ‘সাকিব খান’। এবার হিট ‘হিরো আলম’। বগুড়ার ফুলবাড়ী এলাকার শৌখিন খামারি জিয়ামের এই গরু এবার আলোচনার কেন্দ্রে। জিয়াম আদর করে এই গরুর নাম রেখেছেন হিরো আলম। এই নামে না ডাকলে মন খারাপ করেন গরুটির মালিক জিয়াম!

পিরোজপুর জেলার সবচেয়ে বড় গরু ‘লাল বাদশা’ও গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এসব তারকা গরুর পাশাপাশি সাধারণ গরুও দেদার বিক্রি হচ্ছে। তবে ফি বছর গরুর দাম বাড়লেও খামারিরা তাতে সন্তুষ্ট নন। তাদের কথা : উন্নত জাতের একটি গরুর বাছুর সংগ্রহ ও লালন-পালন করতে যে ব্যয়, আর বাজারে যে দাম, তাতে তাদের পোষায় না। আবার ক্রমবর্ধমান দামের কারণে ক্রেতারাও সন্তুষ্ট নন!

গরু রাজনীতি না করলেও গরুকে নিয়ে কিন্তু রাজনীতি আছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে গরু পরিণত হয়েছে রাজনীতির উপাদানে। সেখানে গরু খাওয়া না খাওয়া নিয়ে গোমূত্র নিয়ে এক শ্রেণির মানুষ উন্মত্ত রাজনীতিতে শরিক হয়েছে। গোমাংস খাওয়া উচিত কি না বা ধর্মে গরুর অবস্হান কী, তা নিয়ে এত বেশি লেখা হয়েছে গত কয়েক বছরে যে, সেই বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। এখানে বরং ফুটবলের একটি কৌশলের কথা বলা যায়। ফুটবলে ‘ফলস রান’ নামে একটি কৌশল আছে। যখন পেনাল্টি বক্সে বল বাড়ানো হচ্ছে, তখন আগুয়ান স্ট্রাইকার হঠাৎ হুড়মুড় করে দৌড়ালেন একদিকে। উপস্হিত ডিফেন্ডারের দল তার পিছু পিছু সেদিকে ছুটল। অথচ বল তার দিকে দেওয়া হলো না, দেওয়া হবে না জেনেই তিনি দৌড়েছেন। বল ঠেলে দেওয়া হলো অন্য এক দিকে। একটু পিছন থেকে দ্বিতীয় স্ট্রাইকার এসে নিরিবিলিতে গোল করে গেলেন। দ্বিতীয় স্ট্রাইকারের জন্য ফাঁকা জমি তৈরি করার উদ্দেশ্যেই প্রথম স্ট্রাইকারের এত দৌড়োদৌড়ি। ভারতীয় রাজনীতি জনগণকে বোকা বানানো এবং অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের প্রকল্প থেকে তাদের সরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে এমন ফলস রানের উদাহরণ নেহাত কম নয়। গো-রাজনীতি সেই তালিকায় একটি সফল সংযোজন।

রাজনীতির আলোচনায় না গিয়ে আমরা বরং গরু নিয়ে কিছু নিরীহ আলোচনা সেরে নিতে পারি। গরু কেবল লাথি কিংবা গুঁতোই দেয় না; বরং দুধ দেয়, মাংসও দেয়। অনেকটা শিল্পপতিদের মতো। তারা কেবল ‘শ্রম শোষণ’ই করে না, জীবিকা দেয়, মজুরি দেয়, যা দিয়ে গরিব মানুষ বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করে। গরু আমাদের আরো অনেক কিছুই দেয়। হাম্বা দেয়, হাড়, লেজ, গোবর, চামড়াও দেয়। গোমূত্র জমিকে উর্বর করে। কোনো কোনো দেশে তা পবিত্রতার প্রতীক। ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। যদিও গোমূত্র বা গোচোনা অনেক ‘বিধ্বংসী’ ক্ষমতার অধিকারী। কথায় আছে, ‘সোয়া মণ দুধ নষ্ট করে এক ফোঁটা গোচোনা।’ এর মর্মার্থ হলো, সোয়া এক মণ দুধের মধ্যে এক ফোঁটা চোনা, মানে গরুর এক ফোঁটা মূত্র পড়লে তা নষ্ট হয়ে যায়, খাওয়ার উপযুক্ত থাকে না।

আমাদের জীবনযাত্রা অর্থনীতির সঙ্গে গরুর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ছোটবেলায় গরু নিয়ে রচনা লেখেনি এমন মানুষ নেই বললেই চলে। বাবা-মা কিংবা শিক্ষক-অভিভাবক-প্রেয়সীর কাছে গরু সম্বোধন শোনেনি এমন হতভাগ্য বাঙালিও বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না।

মানুষের জীবনে এমন কোনো ক্ষেত্র পাওয়া দুষ্কর, যেখানে গরুর ভূমিকা নেই। তাই গরু হলো এই পৃথিবীর সব মানুষের কাছে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গৃহপালিত পশু। সবচেয়ে সম্মানিত প্রাণীও বটে। কোনো কোনো সম্প্রদায় গরুকে ‘মাতা’ বলে সম্মান করে।

গরু হারালে মানুষের নাকি কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়। কথিত আছে, গ্রামের এক লোকের গরু হারালে সে সকালে খুঁজতে বেরিয়ে দুপুরে শুষ্ক মুখে বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের পর পুত্রকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে এক গ্লাস পানি আনতে বলেন। এটা শুনে স্ত্রী বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? ছেলেকে কেউ ভাই বলে? ‘এর জবাবে নাকি লোকটি বলেছিল, ‘গরু হারালে এমনই হয়, মা।’

গরু নিয়ে বিভিন্ন মর্মস্পর্শী সাহিত্য রচনা করা হয়েছে। সেসব উল্লেখ করলে কলেবর অনেক বড় হয়ে যাবে। তবে একজন ফেসবুক কবির কবিতা উল্লেখ করা যেতে পারে : ‘মানুষের পোষা গোরু/পাগুলোই সরু সরু।/বাছুরেরা ঘরে ঘেরা/দুধ খায় মানুষেরা!’ বাছুরকে বেঁধে রেখে বঞ্চিত করে গরুর দুধ খেয়ে যুগে যুগে মানুষ পুষ্ট হয়েছে।

এই উপকারী প্রাণীটির বানান নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে তর্কাতর্কির ঘটনা ঘটে। ‘গরু’ না ‘গোরু’—এ নিয়ে অনেক পণ্ডিতের মধ্যে রয়েছে সংশয়। ২০১৬ সালের আগেও আমাদের দেশে অকাতরে নির্দ্বিধায় লেখা হয়েছে গরু। কিন্তু এরপর অভিধানে আকস্মিক ‘গোরু’ লেখা শুরু হয়।

কোনো কোনো পণ্ডিত প্রাচীন বই-পুস্তক ঘেঁটে বলেন, ৫০টি চর্যাপদের মধ্যে ‘গরু’ শব্দ নেই। ১৪৫০-১৫০০ খ্িরষ্টাব্দে বড়ু চণ্ডীদাস লিখেছেন গরু, গরূ, গোরো এবং বিদ্যাপতি লিখেছেন ‘গরুঅ’। ১৫০০ খ্িরষ্টাব্দে মালাধর বসু লিখেছেন ‘গোরু’, ১৬০০ খ্িরষ্টাব্দে মুকুন্দ দাস লিখেছেন ‘গোরু’ এবং ১৯২৭ খ্িরষ্টাব্দে নজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘গোরু’। ১৯২৯-৩০ খ্িরষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের লেখায়ও ‘গোরু’ বানান দেখা যায়। যদিও পরে তিনি ‘গরু’ লিখতে শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গেও সেই সূত্রে গরু প্রচলিত হয়ে যায়।

গো (সংস্কৃত, গম+ও) /গোরু/গরু (সংস্কৃত, গরূপ) অর্থ হলো: জ্ঞান, ঐশ্বর্য, ধনু, গাভি, ষাঁড়, বৃষ, নিরেট বোকা/মূর্খ প্রভৃতি।

বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি উচ্চারণ অভিধান ও ব্যাবহারিক বাংলা অভিধানে ‘গরু’ লেখা হয়েছে। কারণ সংবৃত অ-ধ্বনির পরে ই/ঈ/উ/ঊ-কার থাকলে অ-ধ্বনি ও-ধ্বনি উচ্চারিত হয়। যেমন : গরু>গোরু। জামিল চৌধুরী সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’ (২০১৬ খ্িরষ্টাব্দ) লিখেছে ‘গোরু’।

পণ্ডিতদের মধ্যে বানান নিয়ে দলাদলি থাকলেও গরুর কিন্তু এ নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তাদের তো জন্ম হয়েছে জবাই ও কোরবানি হওয়ার জন্য! সমাজে ও পরিবারে উপকারী ব্যক্তিরা যেমনটি হয়।

তবে সব মানুষই কিন্তু প্রকারান্তরে গরু হতে চেষ্টা করে। এ কারণেই পৃথিবীভর্তি ভালো মানুষকে গো-বেচারা বলা হয়!

লেখক: রম্য লেখক

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন