শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

গৌরবোজ্জ্বল সত্তরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২২, ০৯:৫২
৬ জুলাই, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ৭০ বছরে পদার্পণ করছে। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডের গগনশিরীষ গাছগুলোর মতো দেশের শিক্ষা ও গবেষণায় বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করে। লক্ষ্য ছিল—উত্তরাঞ্চলের অবহেলিত জনগোষ্ঠীসহ অন্যান্য অঞ্চলের মানুষকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সামনে নেওয়া। ১৯৪৭ সালে স্যাডলার কমিশনের সুপারিশের আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জোরালো দাবির পর ১৯৫০ সালে রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি হয়। ১৯৫২ সালে শহরে এক জনসভায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জোর দাবি তোলা হয়। পরে তত্কালীন আইনসভার সদস্য মাদারবখশের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাশ হয়।


প্রফেসর আই এইচ জুবেরীকে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হলে ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজে এর ক্লাস শুরু হয়। সাতটি বিভাগ আর ১৬১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। পরে অস্ট্রেলিয়ান স্থপতি ড. সোয়ানিটমাসের পরিকল্পনায় মতিহারের সবুজ চত্বরের নিজ ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৬৯-এর গণ-অভু্যত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সব আন্দোলন-সংগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্র‚য়ারি হানাদার বাহিনীর হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার শহিদ হওয়ায় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম বার যুক্ত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। মহান মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক হবিবুর রহমান, মীর আবদুল কাইয়ুম, সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাড়াও ৩০ জন ছাত্র, কর্মকর্তা ও কর্মচারী শহিদ হন। বর্তমানে এর বিভাগ ৫৯টি এবং শিক্ষার্থীসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার।

দীর্ঘ ৬৯ বছরের পথচলায় দেশবরেণ্য জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ভাষাবিজ্ঞানী ড. এনামুল হক, বিজ্ঞানী পিটার বার্টচি, বিচারপতি হাবিবুর রহমান, প্রফেসর হাসান আজিজুল হক, প্রফেসর সনত্কুমার সাহা, প্রফেসর অরুণ কুমার বসাক, প্রফেসর বদরুদ্দীন উমরের মতো শিক্ষকেরা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে এর গবেষকরা স্ট্রবেরি, আমের দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ, মসলিনের পুনরুদ্ধার, খরাপ্রবণ অঞ্চলে পানির সংকট হ্রাস নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর একসময়ের অ্যালামনাই, ছাত্ররাজনীতি, সহশিক্ষায় সম্পৃক্তরা দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন পদে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন ও অদ্যাবধি করছেন। হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট এখন দেশ-বিদেশের মাটিতে স্ব স্ব ক্ষেত্রে আলো ছড়াচ্ছেন।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা ও গবেষণাকে বিশ্বমানের করতে এখনো পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ’৭৩-এর অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে সিনেট ও রাকসু অকার্যকর রাখায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্ররাজনীতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিতর্কিত শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তিকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। সংকট নিরসনের প্রচেষ্টার পরও শিক্ষার্থীদের আবাসন, বিভাগের শ্রেণিকক্ষ এবং শিক্ষকদের চেম্বার সংকট অব্যাহত রয়েছে।

তবে আশার কথা হচ্ছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন পর একজন শিক্ষার্থীবান্ধব উপাচার্য তার প্রশাসনিক টিম নিয়ে যুক্তিসংগত কাজের চেষ্টা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক প্রশাসনের দুর্নীতি, অনিয়ম আর অবৈধ নিয়োগের জেরে অচলাবস্থায় দায়িত্ব নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে গতিশীলতা এসেছে। ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার দায়িত্ব নেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের কোভিড-১৯ সময়কালের হলের আবাসিক ও পরিবহন ফি মওকুফ, ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন, দুটি আবাসিক হল নির্মাণ কাজের উদ্বোধন, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক কিন্তু অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিমা চালু এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইদের এক প্ল্যাটফরমে আনার মতো শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মকাণ্ড চলছে। এছাড়া বিতর্কিত শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তনের উদ্যোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ১০০ জন গবেষককে সম্মাননা এবং ক্যাম্পাসে একজন শিক্ষার্থীর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের ঘটনায় সময়োপযোগী সিদ্ধান্তগুলো প্রশংসিত হয়েছে। বিগত প্রায় সাত দশককালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এর স্নাতকরা দেশ-বিদেশে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সাফল্য ও উত্কর্ষের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয় লাভ করেছে এক অনন্য মর্যাদা। আগামী দিনগুলোতেও এ ধারা অক্ষুণ্ন থাকবে বলে সবার বিশ্বাস।

১৯৫৩ সালে দুটি অনুষদের ছয়টি বিভাগ নিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল, আজ সেখানে ১২টি অনুষদের ৫৯টি বিভাগ ও ছয়টি ইনস্টিটিউটে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চলছে। ভবিষ্যতে এখানে আরো অনুষদ ও বিভাগ চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের গতিশীল ধারা চলমান রয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের জন্য গড়ে উঠছে অনুকূল পরিবেশ। যার ফলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী জ্ঞানকেন্দ্র। তবে এটা সত্য যে, মাঝেমধ্যেই হলে শিক্ষার্থী নির্যাতন, আবাসিক শিক্ষার্থীদের হলে উঠতে বাধা দেওয়ার প্রবণতার সংবাদ বেশ কয়েক বার শিরোনাম হয়েছে, যা কোনো অবস্থাতেই প্রত্যাশিত নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত এসব বিষয় শক্ত হাতে দমন করা। সেই সঙ্গে বর্তমান প্রশাসন আরো মানসম্মত গবেষণা, বহির্বিশ্বের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লিংক প্রোগ্রাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যান্ডিং পুনরুদ্ধার ও বাড়ানো, বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্টে আরো উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। পরিশেষে বলতে চাই, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অ্যালামনাইদের কর্মের মাধ্যমে স্বমহিমায় যুগ যুগ টিকে থাকবে। সব বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করে বিশ্ববিদ্যালয়টি এগিয়ে যাবে। শুভ হোক, প্রাণের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ও সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

 
ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন