শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ইন্টারনেটের প্যাকেজ ও গতির অরাজকতা

আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২২, ১০:১৩

ইংরেজ লেখক এইচ জি ওয়েলস বলিয়াছেন— ‘সভ্যতা হইল শিক্ষা আর বিপর্যয়ের মধ্যে এক দৌড়।’ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে প্রযুক্তিনির্ভর হইয়া উঠিতেছে মানুষের জীবন। প্রযুক্তি শিক্ষা ছাড়া এখন মানুষ অশিক্ষিত। কয়েক বৎসর পূর্বেও মানুষ কল্পনাও করিতে পারে নাই যে, জীবন এত সহজ হইবে! বলা যায়, আমরা ইন্টারনেন্টের জাদুকরি ব্যবস্থায় একধরনের কল্পবিজ্ঞানের যুগে প্রবেশ করিয়াছি। জুলভার্নের কল্পবিজ্ঞানে যাহা ছিল নিতান্তই অতিকল্পনা, তাহার চাইতেও অনেক বেশি কিছু এখন বাস্তব। বরং এমন কিছ প্রাযুক্তিক বাস্তবতার জগতে আমরা প্রবেশ করিয়াছি, যাহা মাত্র ৩০ বৎসর পূর্বেও অকল্পনীয় ছিল। সুতরাং আগামী কয়েক দশকে প্রযুক্তি আমাদের কোথায় লইয়া যাইবে, তাহা অচিন্তনীয়। একটি দেশ তথ্যপ্রযুক্তির মানবসম্পদে ভবিষ্যতে কতখানি উন্নতি করিবে, তাহার ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেই দেশটির ইন্টারনেট গতি এবং তরুণ জনগোষ্ঠীর উপর। আমাদের দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর আধিক্য রহিয়াছে, ইহা এক অপূর্ব সুবিধা। ইহার মধ্যে যাহারা মেধাবী ও শিক্ষিত তাহারা তথ্যপ্রযুক্তিতে অনেক বেশি অবদান রাখিবার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু মুশকিল হইল, আমাদের দেশে ইন্টারনেটের গতি খুবই খারাপ অথচ মূল্য অধিক।

স্পিডটেস্টডটনেটের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি বিশ্বে ১৩৪তম। গত বৎসরের তুলনায় পাঁচ ধাপ নামিয়াছে। অন্যদিকে, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতি বিশ্বে ৯৭তম। ইহাও গত বৎসরের তুলনায় দুই ধাপ নামিয়াছে। অন্যদিকে আরেকটি সূত্র হইতে জানা যায়, বাংলাদেশের সার্বিক ইন্টারনেটের মান বিশ্বেও ১১০টি দেশের তুলনায় ১০৩তম, যেইখানে প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান ৫৯তম। সত্যি কথা বলিতে, আমরা যতই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বলিয়া উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ তুলি না কেন, প্রকৃতপক্ষে প্রকৃত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হইতে আমরা বিশ বাও জলে ডুবিয়া রহিয়াছি। বহু বৎসর ধরিয়া আমাদের না রহিয়াছে উচ্চগতির ইন্টারনেট, না রহিয়াছে সাশ্রয়ী প্যাকেজ। বিটিআরসির সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত মে মাস অবধি বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের গ্রাহক রহিয়াছে ১১ কোটি ৪৫ লক্ষ। অন্যদিকে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১২ কোটি ৫৫ লক্ষ। অর্থাৎ সিংহভাগ গ্রাহক মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করে। আমরা বহু পূর্বে ফোরজি প্রযুক্তিতে প্রবেশ করিয়াছি। কিন্তু আমাদের দেশের প্রায় সব অপারেটরের ইন্টারনেটের গতি ফোরজি গতির ন্যূনতম মান বজায় রাখিতে পারে না। উচ্চমূল্যের ট্যারিফের কথা তো বারবার আলোচনায় আসিয়াছে। বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরদের শত শত ইন্টারনেট প্যাকেজ রহিয়াছে এবং তাহার বেশির ভাগই অত্যন্ত সুচতুর কৌশলে সাজানো। ছোট্ট করিয়া শর্ত প্রযোজ্যের মধ্যে শুভংকরের ফাঁকি রাখিয়া দেয় তাহারা। এবং সরকার বহুদিন ধরিয়া অল্প অল্প করিয়া এই অরাজকতা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করিতেছে বলিয়া মনে হইল উহা যেন এক পা আগাইয়া দুই পা পিছাইবার মতো।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মোবাইল ইন্টারনেটের খরচ যে ডাকাতির মতো— তাহা বুঝা যায় প্রতিবেশী ভারতের মোবাইল ইন্টারনেটের প্যাকেজমূল্য যাচাই করিয়া। ভারতে ভিআই কোম্পানির ৮৪ দিনের জন্য প্রতিদিন দেড় জিবি ইন্টারনেট (মোট ১২৬ জিবি) প্যাকেজমূল্য মাত্র ৭১৯ রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে আট শত টাকার কাছাকাছি)। কেবল তাহাই নহে, এই টাকায় সকল ভয়েজ কল ও এসএমএস তিন মাসের জন্য সম্পূর্ণ ফ্রি। অর্থাৎ মাসে ৪৫ জিবি ইন্টারনেট, ফ্রি ভয়েজ কল ও এসএমএসের মূল্য মাত্র ২৯৫ টাকার কাছাকাছি! ভিআই প্যাকেজমূল্য সবচাইতে বেশি। আরো সাশ্রয়ী প্যাকেজ মিলিতেছে এয়ারটেল ও জিয়ো মোবাইল অপারেটর হইতে। প্রথম বিশ্বে ফ্রি হটস্পট থাকে বলিয়া মোবাইল ডেটা ব্যবহার করিতেই হয় না। তথ্যপ্রযুক্তিতে উন্নত দেশগুলির তুলনায় বাংলাদেশের অপারেটররা ১০-২০ গুণ অধিক মূল্যে অল্পগতির ইন্টারনেট দিতেছে। মনে রাখিতে হইবে, ইন্টারনেট এখন বিলাসিতা নহে, বরং বিশ্বের উন্মুক্ত জ্ঞানভান্ডারে প্রবেশপথের চাবিকাঠি। সেই চাবিকাঠি যদি দুর্লভ হয়, অর্থাৎ অধিকমূল্যে ক্রয় করিতে হয়, তবে তাহা আত্মঘাতী হইবে।

ইত্তেফাক/এসজেড