স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেট অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা তছনছ হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো যেন মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। সিলেট নগরীসহ প্রতিটি সড়কে প্রায় ছোট খাটো দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্বরপুর, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ছাতক জগন্নাথপুরসহ বিভিন্ন উপজেলার সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ। কোনো কোনো স্থানে বন্যার পানির তোড়ে সড়ক, ব্রিজ, কালভার্টের অস্থিত্ব নেই।
সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় সড়ক ভেঙে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব সড়ক মেরামত ও যান চলাচল উপযোগী করতে মোট ৩ হাজার ৪৫৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকার প্রয়োজন বলে সিলেট সিটি করপোরেশন, এলজিইডি ও সড়ক জনপথ সূত্র জানায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, বরাদ্দ চেয়ে ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।
এদিকে, রাস্তাঘাট বন্ধ থাকায় বিভিন্ন স্থানে ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও স্থবির হয়ে পড়েছে। সিলেটে গোয়াইনঘাট উপজেলা পর্যটন সমৃদ্ধ। কিন্তু গোয়াইনঘাট-সালুটিকর সড়ক, বঙ্গবীর-হাদারপর সড়ক, গোয়াইনঘাট-দৌবাড়ী সড়ক, গোয়াইনঘাট-রাধানগর সড়কের অবস্থা খুব খারাপ। ফলে রাতারগুল, বিছনাকান্দি, জাফলংসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটকরা যেতে পারছেন না। ফলে পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ছোট বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রায় অচল।
প্রায় দেড়মাস হলো এখনো বিভিন্ন উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের ও উপজেলা সদরের সঙ্গে ইউনিয়ন সড়কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বন্যার পানিতে এখানো তলিয়ে আছে অনেক সড়ক। সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বিয়ানীবাজার উপজেলার কয়েকটি স্থানে এখনো সড়কের উপর পানি। আর যেসব স্থান থেকে বন্যার পানি নেমেছে, সেসব স্থানের সড়কগুলোর ক্ষত বেশ বড় বড়। ভয়াবহ বন্যার স্রোতে সীমান্তবর্তী গ্রামীণ জনপদের সড়ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাহাড়ি ঢল ও বন্যার স্রোতে বিলীন হয়ে গেছে পাকা সড়ক।
এদিকে, ছাতক ও জগন্নাথপুরের এলজিইডি প্রকৌশলী জানান, ছাতক উপজেলার ২৪টি সড়কের ৬২১ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক ভেঙে গেছে। এসব মেরামত করতে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার প্রয়োজন এবং জগন্নাথপুর উপজেলার ৮৪টি সড়কের ১৮০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতি পোষাতে ১৪০ কোটি টাকার প্রয়োজন। জরুরি ভিত্তিতে কোনো কোনো স্থানে বালি ও ইট দিয়ে কোনো রকমে যান চলাচল উপযোগী করা হচ্ছে। কিন্তু ভাঙা সড়কে চলাচল দারুণ কষ্ট ও ঝুঁকিপূর্ণ।
সিলেট সিটি করপোরশেন (সিসিক) সূত্র জানায়, বন্যায় মহানগরী এলাকার ১৮৬ দশমিক ৫৩ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নগরীর ৯৬ দশমিক ৭২ কিলোমিটার ড্রেন, প্রায় এক কিলোমিটার রিটেনিং ওয়াল, ৬০ কিলোমিটার ফুটপাত ও ৮২ কিলোমিটার পানির লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরসিসি রাস্তা ছাড়াও বেশ কিছু এসপল্ট ও সিসি রাস্তায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জানান।
নূর আজিজুর জানান, সড়কের এই ক্ষতি পুষাতে ৩২৮ কোটি টাকা প্রয়োজন। বরাদ্দ চেয়ে ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও সিটি করপোরেশনের হিসাব মতে, এবারের বন্যায় শুধু সিলেট জেলায় প্রায় ১৬০০ কিলোমিটারের বেশি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক সেতু।
এপ্রিলের শেষে পাহাড়ি ঢল প্রথম ধাক্কা দেয় সুনামগঞ্জের ফসলী মাঠে। এটা শেষ হতে না হতেই মে মাসে সিলেটে ও সুনামগঞ্জের জনপদে বন্যা ধাক্কা দেয়। এর ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতে জুন মাসে স্মরণকালে ভয়াবহ বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের বাসাবাড়ি ডুবিয়ে দেয়। মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জেলা শহরের সাথে সব উপজেলার সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বেশির ভাগ এলাকার পানি নেমে গেলেও এখনো সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়নি।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ জানায়, বিভাগের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় মোট ২ হাজার ৪৩১ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব সড়ক মেরামত বা সংস্কারে লাগবে ২ হাজার ৫৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ২ কিলোমিটার ৫৯৬ মিটার ক্ষতিগ্রস্ত সেতু মেরামতে ৭২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা প্রয়োজন।
সওজ সূত্র জানায়, এবারের বন্যায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন ১৭টি রাস্তার ১৬৬ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো কয়েকটি রাস্তা পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সারি-গোয়াইনঘাট ও দরবস্ত-কানাইঘাট সড়ক। সবমিলিয়ে সড়কের স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে ৩ হাজার ৪৫৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকার প্রয়োজন।
সূত্র মতে, আপাতত বিভাগীয় মেরামতের মাধ্যমে সড়কগুলো যান চলাচলের উপযোগী করা হচ্ছে। তবে বরাদ্দ না পাওয়া গেলে স্থায়ী মেরামত সম্ভব হবে না।
এলজিইডি সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী এনামুল কবীর বলেন, এ বিভাগে বন্যায় এলজিইডির আওতাধীন সড়কের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বালুর বস্তা ফেলে ঢল আটকানোর চেষ্টা করায় ক্ষতি কিছুটা কমানো গেছে। ইট ও বালু ফেলে আপাতত যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চলছে।