বর্ষায় পাহাড়ের রূপ যায় বদলে তাই সমতলের ভ্রমণপিয়াসীরা এ সময় ছুট দেয় পার্বত্য জেলাগুলোতে। তবে, বর্ষায় পাহাড়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান নিঃসন্দেহে সাজেক। যারা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ তারা ছুটে যান গভীরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঝরনা, কেওক্রাডাংয়ের চূড়া, বগা লেকে। তবে, শহুরে মানুষের নিরাপদ ভ্রমণের জন্য সাজেকই সেরা। সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ভাসমান সাদা মেঘের ছোঁয়া পেতে এই বর্ষায় মানুষ ছুটে আসছেন মেঘকন্যা সাজেকে। এ সময়টাই মেঘের রাজ্য সাজেক থেকে পাহাড়ে বর্ষার সৌন্দর্য উপভোগের উপযুক্ত সময়। ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সীমান্তবর্তী চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যের এ সাজেক ভ্যালি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত। তবে, খাগড়াছড়ি হয়ে যাওয়ার পথ সহজ।
সমতল থেকে প্রায় ৩ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় সাজেক হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। এর আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। পাহাড় সবুজ আর মেঘের রাজত্ব এখানে। কখনো কখনো মেঘের আড়ালে হারিয়ে যায় পাহাড় চূড়া। দূরে দেখা যায় ভারতের মিজোরাম রাজ্যের পাহাড়। ছিমছাম সাজানো-গোছানো একেকটা গ্রাম মন ভরিয়ে দেয়। সাজেকে ঢুকতেই প্রথমে পড়ে রুইলুই পাড়া, যার উচ্চতা ১ হাজার ৮০০ ফুট। এখানে লুসাই, পাংখোয়া ও ত্রিপুরাদের বাস। সাজেকের শেষ গ্রাম কংলক পাড়া। কংলক পাড়া থেকে ভারতের লুসাই পাহাড় দেখা যায়, এ পাহাড় থেকেই কর্ণফুলী নদীর জন্ম। সাজেক বিজিবি ক্যাম্পের পর আর কোনো ক্যাম্প না থাকায় নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় কখনো কখনো কংলক পাড়ায় পর্যটকদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত থাকে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, আধুনিক পর্যটনের আদলে সাজেককে সাজানো হয়েছে। সাজেককে জনসাধারণের সুবিধার্থে আরো দৃষ্টিনন্দন করতে কাজ করছে সেনাবাহিনী। পাশাপাশি উন্নত জীবনযাত্রার সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে সেখানে বসবাসরত পাংখোয়া, লুসাই ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষ। পর্যটনসংশ্লিষ্ট নানা কর্মসংস্থান ও আর্থিক কাজে জড়িত থেকে তাদের জীবনমানেরও উন্নতি ঘটেছে। তবে, সাজেকে যত্রতত্র গড়ে উঠছে রিসোর্ট, হোটেল বা পাকা স্থাপনা। কোনো পরিকল্পনা না থাকায় তা পাহাড়ের সৌন্দর্য নষ্ট করছে।
খাগড়াছড়ি জেলা শহর থেকে সাজেকের দূরত্ব প্রায় ৬৯ কিলোমিটার। পাহাড়ি নদী কাচালং-মাচালং ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবেন সাজেকের প্রবেশদ্বার রুইলুই পাড়ায়। রুইলুই পাড়ায় সেনাবাহিনীর সার্বিক সহযোগিতায় পর্যটকদের জন্য বেশকিছু বিনোদনের স্পট রয়েছে। এরমধ্যে হ্যারিজন গার্ডেন, ছায়াবীথি, রংধনু ব্রিজ, পাথরের বাগান উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য একাধিক বিশ্রামাগার ও ক্লাবঘরও রয়েছে রুইলুই পাড়ায়। কংলক রুইলুই থেকে দেড় ঘণ্টার হাঁটার পথ। কংলকে পাংখোয়াদের নিবাস। পাংখোয়ারা সবসময় সবার ওপরে থাকতে বিশ্বাসী তাই তারা সর্বোচ্চ চূড়ায় বসবাস করে। কংলকের পরেই ভারতের মিজোরাম।
সাজেক রাঙ্গামাটি জেলায় হলেও সড়ক পথে চলাচলের একমাত্র মাধ্যম খাগড়াছড়ি দিয়ে। এই সাজেকের কারণেই অনেকটা পালটে গেছে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যবস্থা। বিশেষ করে পরিবহন ও হোটেল ব্যবসা জমে উঠেছে বেশ। সাজেকের পর্যটকরা খাগড়াছড়ি জেলা সদরে অবস্থানের ফলে হোটেলগুলোতে ভিড় লেগেই থাকে। এছাড়াও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প ও তাঁতে বোনা কাপড়ের দোকানেও পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে।
সাজেকে সেনাবাহিনী পরিচালিত দুটি রিসোর্ট রয়েছে। একটি সাজেক রিসোর্ট, অন্যটি রুন্ময় রিসোর্ট। সাজেক রিসোর্টে চারটি রুম রয়েছে। যেগুলোর ভাড়া ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। রুন্ময় রিসোর্টে পাঁচটি রুম রয়েছে। যেগুলোর ভাড়া সাড়ে ৪ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা। সাজেক ভ্যালিতে এখন ছোটবড় মিলে ৩০০-এর বেশি কটেজ, রিসোর্ট রয়েছে। এর মধ্যে আবার কিছু কিছু পাবেন তারকা মানের। এসব রিসোর্টে রুম পেতে আপনাকে আগেভাগে বুকিং নিতে হবে। এরপর মেঘপুঞ্জি, ছাউনি ইকো কুঠির, লুসাই ভিলেজসহ বেশ কিছু কটেজে প্রতি রাতে ভাড়া গুনতে হয় ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া সাম্পারী, পাহাড়িকা রিসোর্ট, গরবা, হিমালয় রিসোর্ট মেঘ মাচাং, মেঘ কাব্য প্রভৃতি মধ্যম মানের কটেজে প্রতিদিন ভাড়া গুনতে হবে ৩ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা। এছাড়া সাজেকে ২ হাজার টাকাতেও কটেজ মিলবে। বন্ধের দিন ছাড়া আসলে দরদাম করে ভালো কটেজে বাজেটের মধ্যে থাকারও সুযোগ হয় কখনো কখনো।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে সাজেক যেতে পিকআপ, চান্দের গাড়ি ও সাফারি জিপ ভাড়ায় পাওয়া যায়। জেলা সদর থেকে সাজেকে সাফারি জিপ রিজার্ভ ভাড়া ৬ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৮ হাজার ৩০০ টাকা, চান্দের গাড়ি ৬ হাজার টাকা থেকে ৭ হাজার ৮০০ টাকা এবং পিকআপ ভাড়া ৬ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৮ হাজার ৫০০ টাকা।
রিছাং ও তৈদুইছড়া ঝরনা
বর্ষায় মেঘকন্যা সাজেক যেমন অপরূপা হয়ে উঠে, তেমনি এ সময়টায় এখানকার পাহাড়ি ঝিরি-ঝরনাগুলোও থাকে অসাধারণ উপভোগ্য। তাই সাজেক ভ্রমণে এসে খাগড়াছড়ির আলুটিলার রিছাং ঝরনাও ঘুরে যেতে পারেন। রিছাং দেখতে হলে চাঁদের গাড়ি, লোকাল বাস বা সিএনজি করে আলুটিলা থেকে আরো দুই কিলোমিটার এগিয়ে প্রথমে হৃদয় চেম্বার এলাকায় যেতে হবে। সেখান থেকে প্রায় সোয়া দুই কিলোমিটার দূরে রিছাং ঝরনা। এই পথ হেঁটে বা মোটরসাইকেলে করে যেতে হবে। মোটরসাইকেলে জনপ্রতি ৫০ টাকা ভাড়া, ফিরতি পথে নেয় ১০০ টাকা। চাঁদের গাড়ি বা সিএনজি নিয়ে গেলে ঝরনা থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে নামতে হবে, বাকিটা হেঁটে যেতে হবে।
সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় থেকে হেঁটে প্রায় হাজার ফুট নিচে নেমে দেখা মিলবে মনোমুগ্ধকর ঝরনা। পাহাড়ের শিলা পাথরের বুক চিড়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ জলরাশি অবিরাম আছড়ে পড়ছে প্রায় ৩০ ফুট নিচে। ঝরনার এ স্রোতধারার ঝুম ঝুম শব্দ পাহাড় আর ঘন বন ভেদ করে বহু দূরে চলে যায়। এ শব্দের ঘোরেই পর্যটকদের কাছে ডেকে নেয় রিছাং। প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্টি ঝরনাটির। ঝরনার আছড়ে পড়া শীতল জলরাশিতে আনন্দস্নানে মাতোয়ারা হয়ে উঠেন পর্যটকরা। দীঘিনালায় রয়েছে আরেকটি অসাধারণ পাহাড়ি ঝরনা তৈদুইছড়া। খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় সবুজ পাহাড় আর বুনো জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত নয়নাভিরাম ঝরনা দুটির নাম তৈদুইছড়া ঝরনা। বাংলাদেশের যে কয়েকটি নয়নাভিরাম ঝরনা রয়েছে তার মধ্যে তৈদুইছড়া ১ ও ২ অন্যতম।