শনিবার, ১০ জুন ২০২৩, ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

পানিতে ডোবা প্রতিরোধে সচেতনতা 

আপডেট : ২৫ জুলাই ২০২২, ০১:৩৬

বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু একটি নিত্যদিনের ঘটনা। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু ঘটে বেশি। এটি এক ধরনের বৈষম্য। এ বৈষম্য কেবল পানির উৎস বা প্রাপ্তিকেন্দ্রিক নয়। এটি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থানের সুযোগসহ আরো অনেক বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে শহরের তুলনায় গ্রামে পুকুর, ডোবা, খালবিল ও নদীনালার সংখ্যা বেশি, যা এ বৈষম্যকে ত্বরান্বিত করেছে।

বাংলাদেশে স্থানভেদে দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজ, নদীপথে যাতায়াত, পেশা হিসেবে জেলেদের পানির সঙ্গে সখ্য অনিবার্য। স্বভাবতই শিশুরা তাদের বাবামাকে অনুসরণ করে। এভাবেই কর্মব্যস্ত বাবামায়ের দৃষ্টির আড়ালে পানিতে ডুবে অকালে প্রাণ হারায় কোমলমতি শিশুরা। শিক্ষার সঙ্গে সচেতনতার বিষয়টি অনস্বীকার্য। কোনো শিশুকে পানি থেকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাসপাতাল পর্যন্ত নেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে শুরু হয় কুসংস্কারের অনুশীলন। শিশুকে মাথায় নিয়ে নাচা, দৌড়ানো, গায়ে ছাই মেখে ঢেকে রাখা, আরো কত কী কর্মকাণ্ড চলে! এভাবে শিশুর মৃত্যুকে করুণভাবে নিশ্চিত করা হয় কেবল অজ্ঞতার কারণে। অথচ সামান্য তথ্য জ্ঞাপন ও প্রশিক্ষণ মানুষকে সচেতন করতে পারে। এতে বেঁচে যেতে পারে সম্ভাবনাময় অনেক শিশুর প্রাণ। শুধু জানা দরকার পানি থেকে উদ্ধার করা জীবিত শিশুর প্রাথমিক চিকিৎসা কী? এটি কোনো জটিল বিষয় নয়। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে একাডেমিক শিক্ষারও তেমন প্রয়োজন নেই। কেউ পানিতে ডুবে যেতে থাকলে তাকে উদ্ধার করতে হবে পেছন দিক থেকে। নয়তো ডুবন্ত ব্যক্তি তাকে জাপটে ধরে ফেলতে পারে যাতে উভয়ের প্রাণনাশের আশঙ্কা সর্বাধিক। যদি উদ্ধারকারী ব্যক্তি সাঁতার না জানেন, তাহলে একটি লাঠি বা রশি হয়তো দুজনকেই বাঁচাতে পারে। দরকার শুধু সামান্য প্রশিক্ষণের। দরকার উদ্ধার কৌশল জানার।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮-এর তথ্য অনুযায়ী, এক-পাঁচ বছর বয়সের শিশুদের মধ্যে ৫৮শতাংশের মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। এটি বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ, যা সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। উন্নত অনেক দেশ ইতিমধ্যে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। সুখবর নেই মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশের জন্য। এসব দেশে বর্তমানে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে সফলতার খবর পাওয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদনে পানিতে ডোবা প্রতিরোধে ১০টি কাজকে কার্যকরী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এসব কাজের মধ্যে পাঁচটিই হলো সমাজভিত্তিক। সমাজের সব শ্রেণিপেশার মানুষকে সচেতন করে তাদের অংশগ্রহণে এ সফলতা অর্জন করা সম্ভব। অন্য চারটি কাজ হলো সরকারের নীতি ও পরিকল্পনাবিষয়ক। এর পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থার অংশীদারিত্বমূলক সহযোগিতা প্রয়োজন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের সাফল্যের অভিজ্ঞতা থেকে তিনটি কাজকে কার্যকরী হিসেবে গ্রহণ করেছে। গবেষণা সংস্থা সিআইপিআরবির কাজের মাধ্যমেও এর সত্যতা মেলে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতা সংস্থা রয়েল ন্যাশনাল লাইফবোট ইন্সটিটিউশনের (আরএনএলআই) সহায়তায় ‘প্রকল্প ভাসা’ একই ধরনের কাজ এখনো চলমান রেখেছে বরিশালে। কক্সবাজারসহ অনেক বিভাগেই এ ধরনের কাজ চলমান। শিশুকে সকাল নয়টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত শিশুযত্ন কেন্দ্রে রাখা হয়, যা ‘আঁচল’ নামে পরিচিত। একজন নারী মূল পরিচালনাকারী এবং অন্য একজন নারী তার সহায়ক হিসেবে শিশুদের সঙ্গে শিশুযত্ন কেন্দ্র কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অন্য দিকে, স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে বিশেষ ব্যবস্থায় সাঁতার শেখানোর কাজ অব্যাহত আছে। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত সংস্থা সিআইপিআরবির গবেষণায় দেখা গেছে, ৮২ শতাংশ শিশুমৃত্যু ঝুঁকি কমানো সম্ভব কেবল চার ঘণ্টা শিশুকে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে। অন্য দিকে, ছয় থেকে দশ বছর বয়সের শিশুদের বিশেষ ব্যবস্থায় ও স্বল্পমূল্যে সাঁতার শেখানোর মাধ্যমে ৯৬ শতাংশ শিশুমৃত্যু ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

জানা যায়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ শিশু একাডেমি এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত। বাংলাদেশের ১৬টি জেলার, ৪৫টি উপজেলায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পের আওতায় ৮ হাজার শিশুযত্ন কেন্দ্রে ২ লাখ শিশুকে সেবা প্রদান করা হবে। এছাড়াও সাঁতার শেখানো হবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছয় থেকে দশ বছর বয়সি ৩ লাখ ৬০ হাজার শিশুকে। বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকবে বলে জানা যায়। প্রয়োজনীয় কারিগরী সহায়তা প্রদান করবে সিআইপিআরবি। এটি সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ সন্দেহ নেই। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এ প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে এসডিজি-৩ :‘সুস্বাস্হ্য ও কল্যাণ’ অর্জনে এটি অনন্য অবদান রাখবে।

গত ২৮ এপ্রিল ২০২১ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২৫ জুলাইকে ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। বাংলাদেশ সেখানে প্রস্তাবকারী দেশ হিসেবে গর্বিত। এক্ষেত্রে আয়ারল্যান্ডের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। সেই সঙ্গে অন্য ৭৯টি রাষ্ট্রের অবদানও অনস্বীকার্য। সুতরাং পানিতে ডোবা প্রতিরোধ আজ বৈশ্বিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত। আজ বাংলাদেশে দ্বিতীয় বারের মতো পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস পালন করা হচ্ছে। এ দিবসটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেশব্যাপী উদযাপনের উদ্যোগ প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারিভাবে। প্রতিরোধযোগ্য এ শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে সবার সোচ্চার হওয়া এখন সময়ের দাবি।

লেখক : মনিটরিং ইভালুয়েশন অ্যান্ড লার্নিং ম্যানেজার, ইন্টান্যাশনাল ড্রাউনিং প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্স ডিভিশন, সিআইপিআরবি

ইত্তেফাক/ইআ