একটি জাতিরাষ্ট্রের সৃজন ও বিকাশের ভিত্তিভূমি রচিত হয় সেই রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব ও ঐক্যবদ্ধ দেশপ্রেমিকদের সম্মিলিত প্রয়াস ও প্রচেষ্টায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রসঙ্গ সূত্রে কয়েকটি ঘটনা গল্পাকারে বলব, যেগুলো আমাদের ইতিহাসের পাতায় লেখা নেই যদিও। তবে সেই ঘটনাগুলো বিনে সুতার মালার মতো আমাদের মুক্তি-সংগ্রাম ও বিকাশের সঙ্গে নানামাত্রিকে সংযুক্ত। গল্পের মধ্য দিয়ে উঠে আসবে একটি রাষ্ট্রের ইতিবাচক অগ্রযাত্রায় সামষ্টিক জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব ও কর্তব্য কী হওয়া উচিত, কেমন হওয়া উচিত, সেই সব বিষয়।
এক. এ দেশের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালনায় আমার পরিবারের অংশীদারিত্ব রয়েছে। ব্যাংকটির জেনারেল সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন ফজলে ইমাম। একদিন যথাক্রমে তার পরিবারের কিছু ইতিহাস তিনি আমাকে বলছিলেন। তার বাবা সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পাল্প অ্যান্ড পেপার এক্সপার্ট। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেইন থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন। শিক্ষাগ্রহণ শেষে তিনি সেখানে চাকরি এবং ২০ হাজার ডলারের বন্ড পেয়ে যান। কিন্তু তিনি সবকিছু উপেক্ষা করে ১৯৬৮ সালে দেশে ফিরে আসেন। তার উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু যে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছেন, সেখানে তার কর্মদক্ষতা কাজে লাগানো। তিনি দেশের শিল্পোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চেয়েছিলেন এবং রেখেছিলেনও।
দুই. এই গল্পও সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন পরিবারের। তার ছোট ভাই বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক সৈয়দ নূর উদ্দীন কানাডার কুইন্স কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করে সেখানেই মোটা অঙ্কের বেতনে চাকরির সুযোগ পেয়ে যান। কিছুদিন সেখানে চাকরিও করেন। বেতনের টাকা দিয়ে শখের একটি মরিস মাইনর গাড়িও ক্রয় করেন। তবে বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, তখন সৈয়দ নূর উদ্দীন সাহেব তার শখের গাড়িটি ৮ হাজার ডলারে বিক্রি করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গঠিত আন্তর্জাতিক সহায়তা তহবিলে প্রদান করলেন এবং দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন।
তিন. এই গল্প বিপ্লবী স্থপতি ঝুটি মঞ্জুর কাদের ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা। ছাত্রজীবনে তিনি একবার দেশের প্রথিতযশা প্রকৌশলী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবের একটি উন্মুক্ত ক্লাসে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শহীদুল্লাহ সাহেবের বক্তব্যের একপর্যায়ে মঞ্জুর কাদের সাহেব সহপাঠীর প্ররোচনায় তাকে একটি প্রশ্ন করেন। প্রশ্নটি ছিল ঢাকা-আরিচা সড়কের ওপরে নির্মিত পাঁচটি সেতুবিষয়ক। যেগুলোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন জনাব শহীদুল্লাহ। মঞ্জুর কাদের সাহেবের প্রশ্ন ছিল এমন, ‘আপনার করা ঐ পাঁচটি ব্রিজের দশা পাঁচ বছরের মধ্যেই এত করুণ কেন?’ জবাবে জনাব শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু মানে যে এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন তা আমরা বুঝতে পারিনি। স্বাধীনতার আগে সেতুর ওপর দিয়ে যেখানে প্রতি পাঁচ মিনিটে একটি গাড়ি চলত, সেখানে স্বাধীনতার পরে চলা শুরু করল হাজার হাজার। ফলে এই দ্রুতবর্ধমান চাপ সামলানোর সক্ষমতা ব্রিজগুলোর ছিল না। বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা বড্ড প্রবল।
আশা করি, গল্প তিনটির মধ্য দিয়ে আমার সূচনা বক্তব্য স্পষ্ট হয়েছে। বাস্তবিক পক্ষে, সে সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতিরাষ্ট্রের সৃজন ও বিকাশের ক্ষেত্রে এমন লাখো দেশপ্রেমিকের ব্যক্তি পর্যায়ের অবদান সম্মিলিতরূপে আবিভূর্ত হয়েছিল, যার সুফল ভোগ করছি আমি, আপনি, আমরা সবাই। বর্তমান সময়ে আমরা বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি সুখি-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণের সংগ্রামে রত। বৈশ্বিক অতিমারি কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সারা পৃথিবীকে নেতিবাচক বাস্তবতার সম্মুখীন করেছে, বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। তবে কিছু দেশ ইতিমধ্যে পরাভূত হয়েছে, বাংলাদেশ এখনো মাথা উঁচু করে লড়ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বুদ্ধিদীপ্ত নীতি ও আন্তরিকতায় আমরা সুরক্ষিত আছি। তবে এসব লড়াই শুধুই প্রধানমন্ত্রীর একার নয়; এ লড়াই আমাদেরও। আমাদেরও সাহসী দেশপ্রেমিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে, বর্তমান সময়ের এক সাহসী দেশপ্রেমিক হারুন অর রশিদ। কোভিড-১৯ অতিমারির সময়ে আমরা সবাই যখন আতঙ্কিত, দেশের আর সব ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যখন বিদেশি কোম্পানিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে, তখন ভিন্ন ও সাহসী ভূমিকায় জনাব হারুন অর রশিদ। তিনি তার প্রতিষ্ঠিত গ্লোব বায়োটেকের ল্যাবে করোনার প্রতিষেধক উদ্ভাবনের তাগিদ দিলেন। তার প্রতিষ্ঠানের একদল বিজ্ঞানী নিরসল পরিশ্রম করে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারও করে ফেললেন। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি অনন্য সক্ষমতার উদাহরণ। যেমন উদাহরণ হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ। গ্লোব বায়োটেকের পক্ষ থেকে টিকার নাম দেওয়া হয়েছে ‘বঙ্গভ্যাক্স’। এটি বঙ্গবন্ধুর ‘বঙ্গ’, এটি বাংলাদেশের ‘বঙ্গ’।
বাংলাদেশের যারা ভবিষ্যৎ, যারা সত্যিকার অর্থে এ দেশের অমিত সম্ভাবনাকে ধারণ করে, তারা হচ্ছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের বিষয়ে অসম্ভব সংবেদনশীল। তিনি ইতিমধ্যে ১২ বছরের ঊর্ধ্বের সবাইকে কোভিড-১৯ টিকার আওতায় এনেছেন। এছাড়া ৫ থেকে ১২ বছরের শিশুদের টিকার আওতায় আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তবে সারা বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী এখনো টিকার জোগানের ক্ষেত্রে অপ্রতুলতা রয়েছে বৈকি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ গ্লোব বায়োটেকের উদ্ভাবিত বঙ্গভ্যাক্সের মাধ্যমে একটি নবসক্ষমতার যুগে প্রবেশ করতে পারে। বঙ্গভ্যাক্স টিকাটি প্রাকৃতিক বিশুদ্ধ এমআরএনএ (মেসেঞ্জার রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) দিয়ে তৈরি, তাই এটি সবচেয়ে বেশি নিরাপদ ও কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই টিকা এক ডোজের। ইঁদুরের দেহে টিকাটি পরীক্ষা করে ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা পাওয়া গেছে। টিকাটি ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ নিরাপদ বলেও প্রমাণিত। এটি পর্যায়ক্রমে বিএমআরসির নির্দেশনা অনুসারে বানরের দেহে পরীক্ষা চালানো হয়েছে। প্রাথমিক ফলাফলে টিকাটি বানরের দেহে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। বানরের দেহে চ্যালেঞ্জ ট্রায়ালে দেখা যায়, করোনার যতগুলো ভ্যারিয়েন্ট এসেছে, তার সব কটিতেই টিকাটি শতভাগ কার্যকর। এটি অ্যানিমেল ট্রায়াল শেষে এখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন পেয়েছে। সেই ধাপগুলো যথাযথ প্রক্রিয়া ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে অতিক্রম করতে পারলে এটির অমিত সম্ভাবনা রূপ নেবে নিশ্চিত সফলতায়। এক্ষেত্রেও দেশপ্রেমিক বিজ্ঞানীর ভূমিকায় আছেন ড. কাকন নাগ ও নাজনীন সুলতানা, যারা উন্নত বিশ্বের উজ্জ্বল জীবনের মোহ ও মায়া ত্যাগ করে বাংলাদেশের জন্য কাজ করছেন নিবেদিতভাবে, নিরলসভাবে। যে বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাময় কর্মক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী।
সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলেই এ দেশের মানুষের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করে বঙ্গভ্যাক্স পৌঁছে যাবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে বঙ্গভ্যাক্স অর্জন করবে বৈশ্বিক মর্যাদা ও গৌরব। এর মানবিক মূল্যের পাশাপাশি বাণিজ্যিক মূল্যও আছে। ঠিকঠাক এবং চাহিদামতো রপ্তানি করতে পারলে বাংলাদেশ উপার্জন করবে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা। সেটি আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরো মজবুত করবে। পাশাপাশি গ্লোবাল পলিটিক্সে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব ও মতামত প্রদানের জায়গাগুলো বলিষ্ঠ হবে। সহযোগিতা ও সুরক্ষানীতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনৈতিক দর্শন ও ভূমিকাকে ত্বরান্বিত করবে। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের স্বকীয় অবস্থান প্রোজ্জ্বল হবে।
সবশেষে একটি কথা বলতে চাই, যখন বাংলাদেশবিরোধী দুষ্ট লোকেরা বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে পাশ কাটিয়ে এ দেশের রিজার্ভের আংশিক হ্রাস ও দ্রব্যমূল্যের আংশিক বৃদ্ধিকে শুধু বাংলাদেশের সমস্যা হিসেবে দেখে এবং প্রোপাগান্ডা ছড়ায়, তখন আমার মতো অনেকেই দেখে একটি নতুন ভোরের বাংলাদেশ, দেখে অমিত সম্ভাবনার অদম্য বাংলাদেশ, দেখে নানা প্রতিকূলতাজয়ী বাংলাদেশ।
লেখক : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির সদস্য